ওষুধ তৈরিতে ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন অনুসৃত হচ্ছে না

রোগ সারানোর জন্য মানুষ ওষুধ সেবন করে। কিন্তু ওষুধের মধ্যে যদি কোনো ক্ষতিকর উপাদান থাকে, তাহলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেজন্য যেসব কাঁচামাল (এপিআই) দিয়ে ওষুধ প্রস্তুত করা হয়, সেগুলোর মান যাচাই করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু দেশে যেসব ওষুধ তৈরি হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর কাঁচামালের মান যাচাই ও নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। ওষুধ প্রস্তুতের আদ্যোপান্ত নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব

আয়নাল হোসেন: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) গাইডলাইন অনুযায়ী, ওষুধ তৈরির আমদানিকৃত কাঁচামালের অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মান নিশ্চিত করার পর ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু দেশে ওষুধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে এপিআইয়ের মান সঠিকভাবে যাচাই হচ্ছে না। কারণ অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানির মান যাচাইয়ের সক্ষমতা নেই। আবার ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও এগুলোর মান পরীক্ষা করছে না। প্রয়োজনীয় লোকবল ও সক্ষমতা না থাকায় তারাও মান যাচাইয়ের দায়িত্ব কোম্পানির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যথাযথভাবে মান নিশ্চিতকরণ ছাড়াই দেশে ওষুধ তৈরি হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৮২টি। এর মধ্যে ২০২টি কোম্পানি উৎপাদনে আছে। এর মধ্যে ৫০টির মতো কোম্পানির বাজারে ভালো অবস্থান রয়েছে। বাকি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বেশ ক্ষুদ্র পর্যায়ে। ওষুধ উৎপাদনের পূর্বশর্ত হিসেবে এপিআই যাচাই করার জন্য কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এ-সংক্রান্ত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও এপিআই যাচাই করা ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে কোম্পানিগুলো মান যাচাই না করেই ওষুধ উৎপাদন করছে। ফলে ওষুধের মধ্যে নানা ধরনের অপদ্রব্য থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা নিম্নমানের ওষুধের জন্য দায়ী। এ ধরনের ওষুধ সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সীতেস চন্দ্র বাছার বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) অনুযায়ী, ওষুধ তৈরির আগে কাঁচামাল পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেশের অনেক কোম্পানির এ সক্ষমতা নেই। তারা বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিসিএসআইআর) অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগ থেকে পরীক্ষা করাচ্ছে। এপিআই আমদানির ক্ষেত্রে উৎস দেশের ভিন্নতার পাশাপাশি নানা ধরনের গ্রেড রয়েছে। কোম্পানিগুলো কোন গ্রেডের কাঁচামাল আমদানি করছে, তার ওপরও ওষুধের মান নির্ভর করে।

ডব্লিএইচও’র গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) হলো গুণগত মান অনুযায়ী, ওষুধ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে যে কোনো ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকিগুলো হ্রাস করা যায়। এপিআইকেন্দ্রিক অপ্রত্যাশিত দূষণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি নি¤œমানের ওষুধ সেবনে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ওষুধে এপিআইয়ের মাত্রা কম বা বেশি হলে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জিএমপিতে উৎপাদনের সব বিষয় বিশদভাবে পরোখ করা হয়। বিশেষ করে এপিআই সংরক্ষণ, সরঞ্জাম থেকে শুরু করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি-সম্পর্কিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে এগিয়ে গেলেও এপিআই উৎপাদনে ঢের পিছিয়ে। দেশের মোট চাহিদার ৯৭ শতাংশ এপিআই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এসব এপিআইয়ের ৬০ শতাংশই আমদানি করা হয় চীন থেকে। আর ভারত থেকে আসে প্রায় ৩৫ শতাংশ। এছাড়া জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে কিছু এপিআই আসে। চীন ও ভারত থেকে যেসব এপিআই আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলো কোন গ্রেডের, তার ওপর নির্ভর করে ওষুধের মান। কিন্তু এসব এপিআইয়ের মান যাচাই না করেই ওষুধ উৎপাদন করা হচ্ছে।

এপিআইয়ের মান পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক বলে জানিয়ে বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিমুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, জিএমপির চাহিদা অনুযায়ী এপিআইয়ের নমুনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এপিআই কতটুকু কার্যক্ষম এবং তাতে কোনো অপদ্রব্য রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হলে পরীক্ষা জরুরি।

জানা গেছে, ভুল এপিআইয়ের কারণে সম্প্রতি ভালসারটন ও রেনেটিডিন ওষুধ বাতিল করা হয়। ২০১২ সালে পপুলার ফার্মার আমদানি করা কালাজ্বরের ওষুধ মিলটেফস সেবনে কয়েকজনের মুত্যু হয়েছিল। এছাড়া ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। জিএমপি অনুসরণ না করে প্যারাসিটামল উৎপাদন করায় সর্বশেষ ৭৬ শিশু মারা যায়। আর আশির দশকে প্রায় ৮০০ শিশুর মৃত্যু ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে নবম জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিনিধিরা দেশের ৭৩টি কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে নানা অনিয়মের চিত্র পায়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানি কাঁচামাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ তৈরি করছে। কারখানাগুলো কাঁচামাল সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। ফলে এসব ওষুধ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কমিটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায়ও কারখানাগুলো পরিদর্শন করে নানা অনিয়ম পায়। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত কাঁচামাল ওষুধ তৈরির আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে না। সেখানে ভেন্ডর লিস্ট (কাঁচামাল আমদানিকৃত দেশের নাম, উৎপাদন তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, যেসব ল্যাব থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে তার প্রতিবেদন) পায়নি প্রতিনিধিদল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আইয়ূব হোসেন বলেন, ‘ওষুধ তৈরির আগে কোম্পানিগুলো নিজ দায়িত্বে কাঁচামাল পরীক্ষা করে। কোনো প্রতিষ্ঠান এ নিয়ম পালন না করে ওষুধ উৎপাদন করলে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তবে ঔষধ প্রশাসনের পক্ষে কাঁচামাল পরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা দৈবচয়ন ভিত্তিতে তৈরি ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করান। সেখানে কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০