সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: রফতানি আদেশ থাকলেও দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। প্রতিবছর একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে কোম্পানিটির দেনা বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০ বছর মেয়াদে চার শতাংশ সুদে ব্যাংকঋণ চান কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
জানা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক দেনার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকে দেনার পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক এশিয়ার কাছে ঋণ রয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের সচিব শাহাদাত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকঋণ বাড়ছে, এটা সত্য। তবে হালনাগাদ সঠিক ঋণের পরিমাণটা আমি এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে আমরা এটাকে ওভারকাম করতে পারব।’
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালে যাত্রা করে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের (২০১৪-১৫) ছিল ৬৬৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে দেশের ১৯টি ব্যাংক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন আছে। এর মধ্যে চারটি ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ কমলেও বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকদেনা বেড়েছে। এর মধ্যে ৬৪ কোটি ৮৮ লাখ ছয় হাজার ৮৬২ টাকা বেড়েছে সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি দুই লাখ টাকা। এরপর ৪৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বেড়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট পাওনা ছিল ৩৩৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর মাসে মোট ঋণের পরিমাণ হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আর পাওনা পরিশোধে অনিয়মিত হলেও বারবার কোম্পানি সময় নিয়ে খেলাপি থেকে রক্ষা পায়, যা রহস্যজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এইকভাবে ২১ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩২০ কোটি বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ব্যাংক এশিয়ার মোট ঋণের পরিমাণ হয় ১১৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকারও অধিক। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ২৫ কোটি ৩৩ লাখ বেড়ে মোট ঋণের পরিমাণ হয়েছে প্রায় ৭৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। একইভাবে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডেরও পাওনা দুই কোটি ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৮ টাকা বেড়ে গত সেপ্টেম্বর ঋণ দাঁড়িয়েছে মোট ২০ কোটি ৬৭ লাখ ৭৩ হাজার ৬২৫ টাকা, যা এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকদেনার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকে দেনার পরিমাণ আগে চেয়ে ১৬০ কোটি টাকা বেড়ে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের গত কয়েক বছর মুনাফা খুবই কম ছিল। গত ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরের নিট মুনাফা করে ছিল ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজর ৭০৭ টাকা। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরের নিট মুনাফা ছিল ৩৪ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ১৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে ১৯টি আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট দেনা হয় ৮১৭ কোটি ১৬ লাখ আট হাজার ৯৫১ টাকা। যা আগের বছরের ছিল ৬৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৭ হাজার ৫৬৬ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যাংকঋণ বেড়েছে ১৫০ কোটি ৪০ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৬ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষে ছয় অর্থবছরের নিট মুনাফার যোগফলের চেয়েও বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের জাহাজ নির্মাণকারী দেশগুলো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে এত বেশি পরিমাণ জাহাজ তৈরির কার্যাদেশ রয়েছে যে তারা আর নতুন করে কার্যাদেশ নিতে ইচ্ছুক নয়। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী জাহাজ ক্রেতারা বিকল্প দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় কার্যাদেশ দিচ্ছে। আর এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ এ প্রতিষ্ঠান মোট ১৩টি জাহাজ রফতানি করে। কয়েক বিশ্বের জাহাজ নির্মাণশিল্পের মন্দাভাব পেছনে ফেলে বর্তমানে এ শিল্পে আশানুরূপ উন্নতি সাধিত হচ্ছে। কিন্তু বর্ণিত আশাপ্রদ ফল সত্তে¡ও বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পকে আর্থিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অবকাঠামোগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ সুদের হার চার শতাংশে এবং ২০ বছর মেয়াদে দেওয়া হলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করেছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। কারণ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে বেগ পেতে হচ্ছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের নাম প্রকাশে একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ঋণ নিয়ে খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছি। কেননা ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। তারা এ মাসে পাওনা কিছু পরিশোধ করবেন বলে কথা দিয়েছেন। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাব।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২৫টি জাহাজ রফতানি করে ১৫ কোটি ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড এককভাবে রফতানি করেছে ১৩টি জাহাজ। বিশ্বমন্দার কারণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে জাহাজ নির্মাণশিল্পে দেশীয় নির্মাতাদের দীর্ঘ মেয়াদে চার শতাংশ সুদে অর্থায়নের সুযোগ করে দিলে এ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কারণ হেভি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দেশের উন্নয়নে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। আর জিডিপিতেও অবদান রয়েছে এ খাতের। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমরা এখন ‘শিপ বিল্ডিং ন্যাশন’ হিসেবে পরিচিত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালে যাত্রা করে। এর মধ্যে দেশে ও বিদেশে কার ফেরি, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাছ ধরার বোট, বার্জ, মাছ ধরার ট্রলার, টাগ বোট ইত্যাদি তৈরিতে বিশ্বমানের দক্ষতা, পরিবেশবান্ধব ও সুনাম স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি গত ১৬ বছরে ১৪০টি জাহাজ নির্মাণ কমরছে, যার মধ্যে ১১৫টি জাহাজ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।