ফারুক আলম, লালমনিরহাট: প্রথম দেখায় মনে হতেই পারে কোনো এক চা-বাগানের প্রবেশ পথ এটি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। রাস্তার দুই পাশের কাঁচা অংশে বাসক পাতার গাছ লাগানো হয়েছে। সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করছেন কয়েকজন নারী। তারপর বস্তা ভরে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি। শুকিয়ে বেচবেন ঔষধ কোম্পানির কাছে।
খুব ছোট ছোট করে করা ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রকল্পের এমন চিত্রের দেখা মেলে রংপুরের পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের ছিটমহলের দাসিয়াছড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ার মাত্র ২৩ জন নারী এমন কাজ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের সফলতা পাওয়ার কথা। তবে শুধু যে বাসকের এমন প্রকল্প রাস্তার দুধারে করা হয়েছে তা নয়। কেউ কেউ বাসক, মেহেদি গাছ দিয়ে তাদের বাড়ির জীবন্ত বেড়া বানিয়েছেন। যতœ ছাড়াই যুগ যুগ বেঁচে থাকে এসব গাছ। সদিচ্ছায় আর পরিকল্পনায় করলে এমন গাছ থেকেই আয় করা সম্ভব। অপর দিকে ইউক্যালিপটাশ বা বিদেশি অনেক গাছের কারণে নষ্ট হয়ে যায় জমি। অনেক স্থানে মরুভূমি তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ হলো এমন অপরিকল্পিত চাষ। এমনটাই জানিয়েছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এমন সব বিদেশি গাছ ছড়ানোর পেছনে প্রধান কারণ সামাজিক আন্দোলনের ঘাটতি।
জানা গেছে, ওষুধ কোম্পানি তাদের বাসকচাষিদের কাছে থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে পাতা কিনছে। যা সংগ্রহ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত তেমন কোনোই পরিশ্রম নেই। পাতা বিক্রির ৮৫ শতাংশ উপকারভোগী মহিলারাই পাচ্ছেন। ৫ শতাংশ উপজেলা প্রশাসন, ১০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদ। এতে ওই দরিদ্রদের সংসার বেশ ভালোই চলছে। যা কি না আশা জাগাচ্ছে বেকার যুবকদেরও মধ্যে।
ওষুধ প্রস্তুতকারক একটি প্রতিষ্ঠানের আরএমও গোলাম রব্বানি জানান, তাদের নিজেদের প্লান্ট রয়েছে। তবুও বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে ভেষজ পাতা কিনতে হয়। তাদের গ্রুপের এগ্রোভেট অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি এসব ভেষজ কিনে থাকে।
লালমনিরহাটে ২টি পৌরসভা, ৫টি উপজেলা, ৪৫টি ইউনিয়নে মোট ৪৭৮টি গ্রাম আছে। নদী পথ আছে ১৮০ কিলোমিটার। কিন্তু কোথাও এমন ঔষধি প্রকল্প নেই। সড়ক বিভাগের ১৮০ কিলোমিটার সড়কের ১২০ কিলোমিটারই হাইওয়ে। এলজিইডির প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। এমন সব সড়কের পাশে বহুবর্ষজীবী ঔষধি গাছ রোপণ এবং চাষে কোনো বিধিগত বাধা নেই বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব সড়কের দুইধার ব্যবহার করে রোপণ করা ঔষধি গাছ থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে। এতে যেমন হবে স্থায়ী প্রাণ, হবে পরিবেশবান্ধব টেকসই জীববৈচিত্র্যের চক্র। সঠিক পরিকল্পনায় একেকটি জেলা থেকে কোটি কোটি টাকা আয় হতে পারে বলে মনে করছেন জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয় বাসিন্দা সুজন কুমার বলেন, সে ছোট বেলায় তাদের বাড়ির সামনে বাসকের, আকন্দ গাছ দিয়ে জীবন্ত বেড়া দিতে দেখেছেন। অনেকেই এসব গাছের পাতা, ডাল নিয়ে যেতেন। কারও ব্যথা থাকলে আকন্দ পাতা গরম করে সেক দিতেন। সর্দিকাশির জন্য বাসকের জুড়ি নেই।
লালমনিরহাটের স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের সমন্বয়ক সাব্বির আহমেদ বলেন, তারা গত ৫ বছর থেকে সবুজায়ন নিয়ে কাজ করছেন। তালের বীজ রোপণ করেছেন বিভিন্ন স্থানে। তারা এবার ঔষধি গাছ নিয়ে কাজ করবে।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ আলী খান বলেন, এলজিইডির প্রায় ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা আছে। রাস্তার দুই ধার গাছ লাগানোর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। উপজেলা পর্যায়ে একটি কমিটি থাকে। সেই কমিটিতে কোনো দপ্তর বা সংগঠনের পক্ষ থেকে আবেদন করলে কমিটি তা পাস করবে। তারপর সেই রেজুলেশন জেলা কমিটি পাস করবে। তাহলেই গাছ লাগাতে পারবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা মাসুদ রানার মতে, পূর্ণবয়স্ক একটি ইউক্যালিপটাশ গাছ প্রতিদিন ১৮০ লিটার পানি শোষণ করে। বড় হওয়া ছাড়া এ গাছের কোনো উপকারী দিক নেই। এই গাছের কোনো বাগানে সুস্থ মানুষ কিছুক্ষণ থাকলে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। এর কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই ইউক্যালিপটাশ বাদ দিয়ে বাসক, বাবলা, আগরের মতো গাছ রোপণ করতে হবে। ঔষধি গাছগুলো মাটিক্ষয় রোধ করে। পশুপাখির আবাসস্থল এবং আদর্শ ছায়াদানকারী। মাটিতে ২৫ শতাংশ পানি, ২৫ শতাংশ বাতাস, ৪৫ শতাংশ খনিজ, ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকে। এমন ঔষধি গাছের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা রক্ষা করা যায়।
সমাজকর্মের শিক্ষক ও গবেষক মাহফুজার রহমান বলেন, রাস্তার দুই পাশে বাসক, অর্জুন, বাবলার মতো গাছ লাগালে শোভাবর্ধন হবে। এগুলো দুস্থদের মাধ্যমে চাষ করলে প্রান্তিক মানুষের টেকসই উন্নয়ন হবে। দীর্ঘদিনের অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, পাশাপাশি এতে যেমন দেশের অগ্রগতি হবে, তেমনি রোগ-বালাইও কমবে। মাছ, পশুর অভয়ারণ্য আছে, গাছের নেই। গাছের অভয়ারণ্য করতে হবে। গাছের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মাধ্যমে প্রান্তিকতাকে নিরাপত্তা দিতে হবে।
জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো এই বিষয়ে সহযোগিতা করবে। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হবে।