কইয়ের তেলে কই ভেজে পকেট ভরলেন রিজেন্সির শীর্ষ কর্তারা

নজরুল ইসলাম: হোটেলের টাকায় নিজেদের নামে জমি কিনে সেটি আবার বায়নানামা দলিলে হোটেলের কাছেই বিক্রি করা হয়েছে। বায়নানামা দলিল অনুযায়ী জমির মূল্য ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি টাকা। বায়না বাবদ অগ্রিম হিসেবে নেয়া হয়েছিল আট কোটি ৮৫ লাখ টাকা। রাজধানীর খিলক্ষেতের ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা এভাবেই এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

তিন কর্মকর্তা হলেন হোটেলটির সাবেক চেয়ারম্যান মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির রেজা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আরিফ মোতাহার।

ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সাবেক চেয়ারম্যান মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও অন্যদের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য থেকে মাসে ছয় লাখ (প্রায় পাঁচ হাজার পাউন্ড) টাকা ইউকে পাউন্ডে নেয়ার অভিযোগ আসে দুদকে। অনুসন্ধানে দুদক জানতে পারে, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা কবির রেজা, মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও আরিফ মোতাহার কোম্পানির টাকায় কক্সবাজার সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে দলিল নম্বর ৬২০/২০১১ মূলে ২৪ শতাংশ ও দলিল নম্বর ২৯২৬/২০১৩ মূলে দুই শতাংশসহ মোট ২৬ শতাংশ নাল জমি নিজেদের নামে কেনেন। কোম্পানির ষষ্ঠ এজিএমের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যক্তির পরিবর্তে কোম্পানির নামে দলিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ওই জমির অংশ মেরিন ড্রাইভ রাস্তার জন্য অধিগ্রহণ করায় সরকারিভাবে জমিটির কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করা হয়। তাই কোম্পানির নামে সাবকবলা দলিল করতে দেরি হয়। পরে তিন উদ্যোক্তা একটি বায়নানামা দলিল (নম্বর ৩৪৬০, তারিখ: ২০/০৯/২০১৫) দিয়ে জমিটি কোম্পানির নামে দখল ও মালিকানা হস্তান্তর করেন। তারপর ওই জমি ও রিজেন্সি হোটেলের ১৪ তলা মর্টগেজ রেখে আইপিডিসি থেকে সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ (২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অনুমোদিত) নেয়া হয়। ওই ঋণের টাকা ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিশোধ করা হয়।

মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ চেয়ারম্যান হিসেবে বেতন বাবদ প্রতি মাসে ছয় লাখ টাকা গ্রহণ করে লোক মারফত উত্তোলন করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট নয় বলে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তিন

উদ্যোক্তা হোটেলের টাকায় নিজেদের নামে জমি কিনে পারস্পরিক যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে আবার সেই জমি বায়নানামা দলিলমূলে হোটেলের কাছে বিক্রি করে আট কোটি ৮৫ লাখ টাকা বায়না বাবদ অগ্রিম গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন, যা ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু তারা সরকারি কর্মচারী না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় মামলা করা সমীচীন হবে না।  

২০২২ সালের ১৬ মার্চ দুদক সচিব মাহবুব হোসেন ও উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম (পরিচালক হিসেবে সম্প্রতি অবসরে গেছেন) স্বাক্ষরিত একটি চিঠি (দুদক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার নথি নম্বর: ০০.০১.০০০০.৫০২.০১.০৫৩.১৮) মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগটি অনুসন্ধান শেষে দুদক জানতে পারে এটি দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। তাই তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/১০৯ ধারায় পুলিশ বিভাগের মাধ্যমে মামলা দায়েরের জন্য কমিশনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সরকারি কর্মচারী নন বিধায় এটি দুদক কমিশনের তফসিলভুক্ত নয়। দুদকের চিঠির জবাবে ২০২২ সালের ১৪ জুন খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সী ছাব্বীর আহম্মদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগকারীকে বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি মামলা দায়ের করতে রাজি হননি। তাই তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা যায়নি।

এদিকে ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি দুদকের এক চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে উপপরিচালক মশিউর রহমান ও সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াতের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে আবার অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বরের কমিশন সভায় (৪৬/২০২২) এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগে অভিযোগটি অনুসন্ধান করেছিলেন উপপরিচালক মোশারফ হোসেইন মৃধা। তিনি সম্প্রতি পরিচালক হিসেবে অবসরে গেছেন।

দুদকের আইন অনুবিভাগের মতামতে বলা হয়েছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/১০৯ ধারাসহ মানি লন্ডারিংয়ের। এখানে অর্থপাচার হয়েছে কি হয়নি, সেটাই মূল বিবেচ্য বিষয়। অর্থপাচারে অপরাধ আপসযোগ্য নয়। অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কোনো বিষয় নয়। অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে নিয়মিত মামলা করতে হবে, প্রমাণিত না হলে পরিসমাপ্তি করা যেতে পারে। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, এই অজুহাতে এটা পরিসমাপ্তির কোনো সুযোগ নেই। দলিল ছাড়াই আইপিডিসি থেকে রিজেন্সি হোটেলে কীভাবে সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে, এই বিষয়টির কোনো অনুসন্ধান হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। ঋণ প্রদানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছিল কি না, অথবা মানি লন্ডারিংয়ের কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কি না, এ বিষয়টিরও সুরাহা প্রয়োজন। দুদকের আইন অনুবিভাগের এই মতামতের পর কমিশন সভায় (৪৬/২০২২) অভিযোগটি আবার অনুসন্ধানের জন্য নতুন টিম গঠন করার প্রস্তাব পাস করা হয়। এছাড়া ২০১৮ সালের নথির অনুসন্ধান এখনও কেন শেষ হয়নি, সেই বিষয়েও অনুসন্ধান করার জন্য একজন কমিশনার মত দেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও আরিফ মোতাহারকে কল করা হলে তাদের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। আর কবির রেজার মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের কোম্পানি সেক্রেটারি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শেয়ারহোল্ডাররা কোর্টে অভিযোগ দিয়েছিল। সেটি বিচারাধীন। পুরো কোম্পানিই কোর্টের অধীনে চলছে। মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও আরিফ মোতাহার অনেক দিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। তারা এখন বোর্ডে নেই, শুধু শেয়ারহোল্ডার।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০