Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:23 pm

কক্সবাজারে তিন জেলের লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ ৭০

প্রতিনিধি, কক্সবাজার: কক্সবাজারে বৃষ্টি কিছুটা কমায় শহরের জলাবদ্ধ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও বেড়েছে প্লাবিত এলাকার পরিধি। এখনও পানিবন্দি আছেন ছয় উপজেলার অন্তত দুই শতাধিক গ্রামের মানুষ। এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া আটটি ফিশিং ট্রলারসহ অন্তত ৭০ জেলের নিখোঁজের তথ্য জানিয়েছেন মালিকরা। এর মধ্যে তিনজনের মরদেহ ভেসে এসেছে উপকূলে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, ‘শুক্রবারের তুলনায় শনিবার বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তবে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।

‘শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২১০ মিলিমিটার। এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টি।’ এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ৪৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল বলে জানান তিনি। এদিকে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কক্সবাজার শহরের জলাবদ্ধ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নত হয়েছে। পানি নেমে গেছে পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকার সব সড়ক, সৈকতসংলগ্ন এলাকা ও মাকের্ট এলাকা থেকে।

এছাড়া শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাঁচা মিয়ার ঘোনা ও পাহাড়তলী এলাকাও জলাবদ্ধতামুক্ত হয়েছে। তবে শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়াসহ আটটি নিম্নাঞ্চল এখনও পানিবন্দি রয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল ও নুনিয়াছড়া এলাকা নিম্নাঞ্চল। সমুদ্র উপকূলের এসব এলাকায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি এখনও পানিবন্দি।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘বৃষ্টি কমে যাওয়ায় হোটেল-মোটেল জোন থেকে এখন পানি নেমে গেছে। তবে বৃষ্টি হলেই এখন আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। নালা উন্নত করা না হলে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।’
উখিয়া উপজেলা ৪০টির বেশি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি থাকার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। উখিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হলদিয়াপালং ও জালিয়া পালং ইউনিয়নে।
এই দুই ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ দুই দিন ধরে পানির মধ্যে বসবাস করছেন। চুলা ধরাতে না পারায় রান্না হচ্ছে না অধিকাংশ ঘরে। জালিয়া পালং ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া, ঘাটঘর পাড়া পাইন্যাশিয়া, সোনাইছড়ি, সোনারপাড়া ডেইপাড়া মনখালি, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়া, মনির মার্কেট, রুমখা পালং, বড়বিল, পাতাবাড়ি, নলবুনিয়া, খেওয়া ছড়ি, বৌ বাজার, কুলাল পাড়া, পাগলির বিল, রাজা পালং ইউনিয়নের কুতুপালং, মাছকারিয়া, লম্বাশিয়া তুতুরবিল, পিনজির কুল, রত্না পালং ইউনিয়নের সাদৃ কাটা, পশ্চিম রত্না, খোন্দকার পাড়া, গয়াল মারা ও পালংখালী ইউনিয়নে থাইংখালী, রহমতের বিল, বালুখালী তৈল খোলা, আঞ্জুমান পাড়া ফারিবিলসহ অন্তত ৪০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যায় উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের অনেক এলাকার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। জালিয়া পালং ও হলদিয়াপালং ইউনিয়নের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হলদিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী জানিয়েছেন, দুই মাসের ব্যবধানে চার দফা বন্যায় তার ইউনিয়নের ২০টির বেশি গ্রামের মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভির হোসেন জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমেও সহযোগিতার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বৃষ্টিতে চকরিয়া-পেকুয়ার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, বিএমচর, কোনাখালী ও বদরখালী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অন্তত ২০ হাজার লোক পানিবন্দি রয়েছে। তলিয়ে গেছে আমন ধানের ক্ষেত ও শীতকালীন বিভিন্ন সবজির চারা। মানকিপুর-সুরাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, ‘বৃষ্টিতে মানিকপুর এলাকায় নিচু এলাকার অন্তত দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছে।’ বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. ছালেকুজ্জামান বলেন, আমার ইউনিয়নের পহরচাঁদা, গোবিন্দপুর ও ডেইঙ্গাকাটা এলাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের নিরাপত্তা ও শুষ্ক খাবার বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
পেকুয়ার সাত ইউনিয়নের মধ্যে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের ১০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম জানান, ইউপি চেয়ারম্যানদের এলাকার খোঁজখবর রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ও নদীতীরবর্তী এলাকায় অবস্থানরত লোকজন নিরাপদে সরিয়ে নিতে উপজেলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান। পেকুয়ার শিলখালী ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, তিন দিনের টানা বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কিছু বসতঘর ও দোকানপাটে পানি ঢুকেছে। এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে পড়ে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া আটটি ফিশিং ট্রলার নিখোঁজ আছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ থাকা এসব ট্রলার ডুবে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু জেলে সাঁতার কেটে উপকূলে ফিরেছে। ট্রলারের আরও অন্তত ৭০ জেলে নিখোঁজ রয়েছে।’
এর মধ্যে গতকাল সকালে কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, পেঁচারদ্বীপ ও কলাতলী উপকূলে ভেসে আসা তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তা।
এর মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেখেরকিল এলাকার নুরুল আমিন (৪০) ও লোহাগাড়া উপজেলার চরমবা এলাকার মোহাম্মদ জালাল (৩৭)।
মরদেহ তিনটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও আশেকুর রহমান।