কক্সবাজারে বিলুপ্তির পথে সাদা বক

কাইমুল ইসলাম ছোটন, কক্সবাজার: ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ। ঐ খানেতে বাস করে কানা বগীর ছা।’ শৈশবে পড়া ছড়ার মতো বছর পাঁচেক আগেও কক্সবাজারে বন, বাঁশের ঝাঁড়, নদী, খাল-ফসলের মাঠ, পানির ছড়া ও সমুদ্র উপকূলে চোখে পড়ত বিশাল সাদা বকের ঝাঁক। প্রায়ই দেখা যেত দলবেঁধে মেঘের বুকে হারিয়ে যাওয়া সাদা বকের সারি। সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন স্থানে শিকারিদের বসা ফাঁদে আটকে পড়ছে এসব বক। ফলে খাবারের সন্ধানে বিল, নদী-জলাশয়ে আসা সাদা বকের খুব বেশি দেখা মিলছে না। দিন দিন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে এসব বক। বন উজাড়, জলাশয় দখল ও শিকারিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত অভিযান না থাকায় কক্সবাজার থেকে এসব সাদা বক বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী দিনুর আলম বলেন, প্রাকৃতিক নান্দনিক পাখি বকের কলরব এখন শুধু স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড় এবং অসাধু শিকারির দৌরাত্ম্যে সাদা বক দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে খাবারের খোঁজে মাছের প্রজেক্টে আসলে, শিকারিদের ফাঁদে আটকা পড়ে এসব বক।

স্থানীরা জানান, এক সময় অনেক বক দেখা যেত। জলাশয় ও ফসলের মাঠে বক দেখে মানুষ আনন্দের খোঁড়াক মেটাত। ফসলের মাঠের পোকামাকড় খেত। কিন্তু এখন দেখা যায় না। পাখিদের বিচরণ তেমন নেই এবং বর্ষায় পানি ছাড়া কিছু থাকে না।

যদিও সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ায় অভিযান চালিয়ে দুষ্কৃতকারীদের পাতা ফাঁদ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১১৭টি সাদা বক। এর মধ্যে ১০৩টি বক অবমুক্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, বকের বৈজ্ঞানিক নাম (Ardea alba), (ইংরেজি: (EGRET)। বাংলাদেশে ১৮ প্রজাতির বক রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি বগা (ছোট বগা, মাঝলা বগা, প্রশান্ত শৈল বগা, বড় বগা ও গো বগা) ৯টি বক (ধুপনি বক, দৈত্য বক, ধলপেট বক, লালচে বক, চীনাকানি বক, দেশি কানি বক, কালোমাথা নিশি বক, মালয়ি নিশি বক, ক্ষুদে নিশি বক) এবং চারটি বগলা (খয়রা বগলা, হলদে বগলা, কালা বগলা, বাঘা বগলা)।

বক আকারে ৪৫ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এদের পা ও লম্বা ঠোঁট ছাড়া সারা দেহ সাদা পালকে আবৃত। বক একসঙ্গে তিন থেকে সাতটি ডিম দেয়। ডিম দেয়ার সপ্তাহের ভেতর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বক সাধারণত মাছ ও পোকামাকড় বেশি খায়। ফসলের পোকা খেয়ে কৃষকের অনেক উপকার করেন। এরা বাঁশঝাড় ও বনে-জঙ্গলে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, সাদা বক কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, জলাশয় দখল, দেশের দেশীয় মাছের সংকট এবং বক শিকার করা। যারা প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানান তিনি।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজিম উদ্দীন শেয়ার বিজকে বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সাদা বক অন্যত্র চলে যাচ্ছে। খাবারের সংকট ও বন্যপ্রাণীর বসবাসের জায়গা দখল হয়ে যাওয়া তার প্রধান কারণ। তিনি আরও বলেন, একসময় কক্সবাজারের অনেকে পাহাড় ও বনঝাড় ছিল। যেখানে বন্যপ্রাণীরা বসবাস করত। কিন্তু এখন সে পরিবেশ নেই। রোহিঙ্গাদের কারণে অনেক বন দখল হয়ে গেছে, প্রয়োজনের তুলনায় মানুষ প্রবেশ করছেন। তাই বক বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জ্যোতির্ময় ভৌমিক বলেন, বন বিভাগ থেকে চিড়িয়াখানা সম্পর্কিত প্রাণীগুলো আমাদের এখানে বেশি আসে। তবে এমন প্রাণী বিলুপ্তির পথে, এটা সদরের ইউএনওর  সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানোর কথা বলেন।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের প্রধান সরওয়ার আলম শেয়ার বিজকে জানান, মেরিন ড্রাইভ সড়কের আশেপাশে এক সময় সাদা বক বাস করত। কিন্তু হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট হওয়ার ফলে কক্সবাজারে প্রচুর পর্যটক আসছেন এবং রোহিঙ্গাদের কারণে অনেক বন উজাড় হয়ে গেছে, যা পাখিদের অনেক ক্ষতি করছে। তা বক দেখা যাচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, কেউ পাখি শিকার করে বিক্রি করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং আদালত প্রমাণ পেলে শাস্তি দিচ্ছেন।

এদিকে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করার দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০