‘অর্থবছরের সাত মাস: বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গতকালের শেয়ার বিজে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হালনাগাদ মাসিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আমাদের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশি ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করা সুদের পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে সেই সুদ পরিশোধের পরিমাণ ৭৬ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার ডলার।
বৈদেশিক ঋণের ইতিহাস বেশ পুরোনো। সভ্যতার প্রাথমিক যুগে গ্রিস ও রোমের শাসকরা বিভিন্ন জাতি বা নগররাষ্ট্র থেকে তখন অর্থ ধার করতেন। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রাজা ও বণিকরা ইতালির ব্যাংকারদের কাছ থেকে অর্থ ধার করতেন। ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপের ক্ষমতাশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিত নিজেদের বৈদেশিক মিশন সফল করার জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও আধুনিকায়নে অর্থের প্রয়োজন হয়। ফলে ঋণ গ্রহণ ও প্রদানে নতুন যুগের সূচনা হয়। বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুনর্গঠন ও উন্নয়নে বৈদেশিক ঋণ বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্র–ম্যান স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আইন পরবর্তী সময়ে মার্শাল প্ল্যান নামে পরিচিতি লাভ করে। নামটি তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট জর্জ মার্শালের নামানুসারে রাখা হয়, যিনি ১৯৪৭ সালে প্রথম এ প্রস্তাব পেশ করেন। মার্শাল প্ল্যানের অধীনে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো অর্থনীতি পুনর্গঠনে ব্যাপক ঋণ নেয়। পরবর্তী সময়ে উত্তর আমেরিকার দেশগুলো উন্নত দেশ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উৎস থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক ঋণ নেয়।
কতিপয় দেশ কঠিন শর্তের জালে পড়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণের চক্রে পতিত হয়। কোন দেশ ঋণের ফাঁদে ফেলে ঋণগ্রহীতা দেশকে কীভাবে বিপাকে ফেলেছে, এগুলো এখন আর আড়ালে নেই। এসব বিবেচনায় রেখে ঋণ নেয়ায় দূরদর্শী হতে হবে। আজ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনোভাবেই নিজেদের সক্ষমতার অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। ঋণ যাতে সহজ শর্তে আনয়ন করা যায়, সে লক্ষ্যে পর্যাপ্ত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। আবার বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে কী কাজে এই খাতের ব্যাংকগুলো ব্যয় করছে, তার তদারকি অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে করতে হবে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলো যদি ঋণকে সফলভাবে ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে শেষ পর্যন্ত ওই ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিতে পারে। বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ সেটা ব্যক্তি খাত কিংবা সরকার নিক, পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়ই। সব ঘাত-অভিঘাত বিবেচনায় রেখে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিলে ঋণফাঁদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। শুধু বৈদেশিক ঋণের সেবা বাড়ালে দেশ ও অর্থনীতি বিপদে পড়তে পারে। ঋণ পেলেই তা নিতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। প্রতিটি ঋণ নেয়ার আগে ঋণের কস্ট বেনিফিট বিশ্লেষণ করা উচিত।