ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: সরকারের বিদেশি ঋণ গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে বেশকিছু কঠিন শর্তের ঋণ রয়েছে। এতে বৈদেশিক ঋণের স্বস্তিদায়ক অবস্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে। কঠিন হয়ে যাচ্ছে বিদেশি ঋণের কিস্তি ও শর্ত। এছাড়া আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটি মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। এতে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ আরও কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ইনটু বাংলাদেশ ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি, কিস্তি পরিশোধসহ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিদেশি ঋণের ভারিত গড় সুদহার ছিল এক দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় এক দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় দুই দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ দুই বছরে ভারিত গড় সুদের হার ৬২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে গেছে।
বিদেশি ঋণের গড় সুদের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের গড় সময়সীমাও কমে আসছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণ শোধের গড় সময় ছিল ১১ দশমিক ৩ বছর। ২০২০-২১ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় ১১ বছর। আর ২০২১-২২ অর্থবছর তা আরও কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪ বছর। একইভাবে সরকারের বিদেশি ঋণের গড় ম্যাচুরিটির মেয়াদকালও কমে আসছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণের গড় ম্যাচুরিটির মেয়াদ ছিল ১৩ দশমিক ১ বছর। ২০২০-২১ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৮ বছর। আর ২০২১-২২ অর্থবছর তা আরও কমে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৭ বছর।
ইআরডি বলছে, সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের শর্ত কঠিন হওয়ার পাশাপাশি চাপ বাড়াচ্ছে ডলারের বিনিময় হার ও লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট (লাইবর) বৃদ্ধি পাওয়া। ২০২০-২১ অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছিল যথাক্রমে চার হাজার ২০৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা ও ১২ হাজার ৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। গত অর্থবছর এ দুই খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে চার হাজার ২২৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩ হাজার ১১৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
ইআরডির তথ্যমতে, আগামী কয়েক বছর সরকারের ঋণ পরিশোধে ব্যয় ক্রমেই বাড়বে। ২০২৭ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তবে নতুন করে ঋণের পরিমাণ না বাড়লে ২০৩০ সালের পর থেকে সরকারের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমতে শুরু করবে। এজন্য আগামী তিন-চার বছরকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং সময় বলে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে সেটি স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সরকারি এমন কিছু প্রকল্পে বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যা অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে, রিজার্ভও কমছে। তাই বিদেশি ঋণ পরিশোধ আগামীতে ডলার ও রিজার্ভের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন বিনিময় হারও দ্রুত পরিবর্তন হবে।
সূত্রমতে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে তিনটি মেগা প্রকল্প বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারকে বেশি চাপে ফেলবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এগুলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও কর্ণফুলী টানেল। এ তিন প্রকল্পের জন্য বছরে কিস্তি দিতে হবে (সুদ ছাড়া) প্রায় ৮০ কোটি ডলার।
বেসরকারি এক গবেষণা সংস্থা প্রকাশিত ‘ইজ বাংলাদেশ মিররিং শ্রীলঙ্কা অ্যান্ড পাকিস্তান?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সরকারের বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পে গৃহীত বিদেশি ঋণ ম্যাচিয়র হয়ে যাবে। এতে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনটিতে তিনটি মেগা প্রকল্পের ঋণ ও বার্ষিক কিস্তির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশ সরকারের বোঝা বাড়াবে। এতে দেখা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে ২০২৬ সালে। এর পর থেকে ২০ বছরে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। এতে বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ দাঁড়াবে (সুদ ছাড়া) ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
একইভাবে চলতি বছর ম্যাচিয়র হবে চীন থেকে নেয়া পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ। এতে আগামী বছর থেকে দুই প্রকল্পের জন্য কিস্তি দিতে হবে যথাক্রমে ১৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার ও পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এ দুই প্রকল্পের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ও ৮০ কোটি ডলার। উভয় ঋণের মেয়াদকাল ১৫ বছর।