নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের দশম দিন রাস্তায় গাড়ি চলাচল ছিল সীমিত। রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেলের চলাচল সপ্তাহের অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, মিরপুর এলাকার রিকশার সংখ্যা একটু বেশি। বিজয় সরণির চেকপোস্টে পুলিশ মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
জরুরি প্রয়োজনে যানবাহন না পেয়ে অনেকে ভোগান্তিতে পড়ছেন। সরেজমিন দেখা যায়, সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়ায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামতেই দৌড়ে এলেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাবে না, এটা রিজার্ভ, চালক এ কথা বলতেই মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে তার। তারপর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার স্ত্রী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতালে তার চেকআপ করাতে হবে। এই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে রিকশায় করে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অটোরিকশা খুঁজছি।’ সেখানে প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি অটোরিকশা না পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করার পর থেকে রিকশা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যাতায়াতের জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাসসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। ফলে অনেকে চিকিৎসার মতো জরুরি প্রয়োজনে যানবাহন না পেয়ে বিপদে পড়ছেন। বিশেষ করে আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় নি¤œবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের বিপদ একটু বেশি।
এদিকে কভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর লকডাউনের মধ্যে ঢাকার মুগদা বিশ্ব রোডে বেশ কয়েকটি দোকানে শাটার অর্ধেক তোলা দেখা গেল। চলছে চোর-পুলিশ খেলা।
দক্ষিণ বাড্ডার এক দোকানদার বলেন, ‘প্রথম প্রথম দু-একদিন দোকান খুলতে ভয় লাগত। গলিতে পুলিশ আসত। এখন কয়দিন ধরে আসে না। সন্ধ্যার দিকে একবার আসে, তখন তাড়াতাড়ি করে ঝাঁপ ফালায়া দিই। সবাই তাই করে।’
এমন চিত্র এখন ঢাকার সবখানে। পুলিশ টহলে এলে দোকান বন্ধ হয়ে যায়, পুলিশ চলে গেলে ফের খোলে। আর পথে মানুষের চলাচলও অনেক বেশি।
এসব দেখে আফতাবনগরের বাসিন্দা সাব্বির হোসেন বলেন, ‘কী হবে ভাই, লকডাউন কি এভাবে চলে? রাস্তায় লোকজন চলছে। কাজে-অকাজে লোকজন বাইর হয়।’
লকডাউনের দশম দিন রাজধানীর অলিগলিতে চলাচল বাড়ার সঙ্গে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাতেও দেখা গেছে ঢিলেঢালা ভাব।
কঠোর লকডাউনের কঠোরতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন নেই বললে চলে। মূল রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা মানলেও অলিগলিতে চলাচলে তার বালাই থাকছে না। শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব তো অনেক পরের কথা, অনেকের মুখে মাস্কও নেই।
মুগদা, মহাখালী, গোপীবাগ, ইত্তেফাক মোড়, ফকিরাপুল, মালিবাগ, মগবাজার, মৌচাক, রামপুরা, কাকরাইল, বিজয়নগর, পল্টন, চানখাঁরপুল, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, লালবাগ, কেল্লার মোড়, বকশীবাজার, পলাশী, আদাবর, শেখেরটেক, রিংরোড, নিউমার্কেট, গ্রিন রোড, শুক্রাবাদ, সোবাহানবাগ, বাড্ডা, মিরপুরের রূপনগর, পল্লবী, আরামবাগসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
মুগদা এলাকায় অলিগলিতে মানুষের চলাচল ছিল স্বাভাবিক দিনের মতোই। সকালে অন্যসব এলাকার মতো বাজার করতে ছিল মানুষের ভিড়। মুগদা বিশ্বরোডে রিকশা চলাচল গত কয়েকদিনের তুলনায় বেশি ছিল। অনেক দোকানই ছিল খোলা। মুগদা থানার পার্শ্ববর্তী এলাকা হলেও পুলিশ, র্যাব বা কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহলে দেখা যায়নি।
গতকাল ছুটির দিন হলেও রাস্তায় লোকজনের কমতি ছিল না মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায়। রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেটকারের চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো। এ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা একেবারে চোখে পড়েনি।
টাউন হলের মসজিদ মার্কেটের উত্তরে ফুটপাতের সবজি বিক্রেতা মকবুল আহমেদ বলেন, ‘আমার কোনো সমস্যা নাই। ভোরে কারওয়ান বাজার থেকে সবজি আনার সময় রাস্তায় কোনো পুলিশ দেখি নাই।’ টাউন হলের বাজারে স্বাভাবিক দিনের মতোই ক্রেতার ভিড় দেখা গেছে। দোকানপাটও খোলা।
এ বাজারের স্যানেটারি ব্যবসায়ী শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘চুরি করে ব্যবসা করতে হচ্ছে। পুলিশও বুঝে। অনেক সময় পুলিশ না দেখার ভান করে চলে যায়।’ নূরজাহান রোডে একটি ওষুধের দোকানে সামনে কয়েকজনকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। আজিমপুর, লালবাগ, কেল্লারমোড়, বকশীবাজার ও পলাশীর অলিগলি ও প্রধান সড়কে মানুষ ও গাড়ি চলাচল আগের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।
এসব এলাকার অলিগলিতে ভ্যানে ফল আর সবজির পসরা আগের মতোই। সবজি ও মুদি দোকানগুলোয় ক্রেতার ভিড়ে স্বাস্থ্যবিধি ছিল উধাও।
একই রকম দৃশ্য লালবাগ চৌরাস্তা, ঢাকেশ্বরী, পলাশীর মোড় ও বকশীবাজারে অলিগলিতেও। এসব এলাকায় পুলিশের তৎপরতা দেখা না গেলেও আজিমপুর চৌরাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল।
আদাবর, শেখেরটেক, রিংরোডে প্রায় সব ধরনের দোকানপাটই খোলা দেখা গেছে। তবে বেশিরভাগ দোকান অর্ধেক খোলা।
দুই সপ্তাহের লকডাউনের দশম দিন রাস্তায় চলাচলকারী বেশিরভাগ মানুষের কাছে মাস্ক থাকলেও তা গলায় ঝুলছে বা থুতনিতে আটকে রয়েছে।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী আবিদুর রহমান কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংকে এসেছেন রোগী নিয়ে। তিনি বলেন, ‘রাস্তা-ঘাটে মানুষের করোনা সচেতনতাবোধ একেবারে কম। মাস্ক নিয়ে বেরুচ্ছেন। কিন্তু মুখে না দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখছেন। আমাদের এখানে করোনাভাইরাস যেভাবে বিস্তার ঘটেছে তার জন্য এটা বিপদ বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।’ চার দিন পরই দুই সপ্তাহের লকডাউন শেষ হতে যাচ্ছে। এরপর কী হবে তা নিয়েও শঙ্কিত আবিদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘সামনে ঈদ। যেভাবে মৃত্যু বাড়ছে সামনে যে কী হবে বুঝতে পারছি না! একজন রোগী নিয়ে এসেছি হাসপাতালে। ভয়ে আছি ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাব।’ কাকরাইলের মোড়ে চেক পোস্টে পুলিশের তৎপর দেখা গেছে। প্রাইভেটকার, সিএনজি বা মোটরসাইকেল থামিয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘২০ থেকে ৩০টি প্রাইভেটকারকে থামিয়ে দেখেছি, অধিকাংশই মিথ্যা কথা বলছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। হয় জরিমানা করা হচ্ছে, নয় তো ছেড়ে দিতে হচ্ছে।’
নিউমার্কেট, গ্রিন রোড এলাকা ঘুরে পুলিশ, র্যাবের উপস্থিতি থাকলেও তাদের তৎপর দেখা যায়নি।