Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 7:28 pm

কতিপয় দেশের অর্থনীতির ধস এবং পুনরুত্থানের ইতিবৃত্ত

আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: ব্যক্তির জীবনে যেমন উত্থান-পতন রয়েছে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। অর্থনীতির গতিপথ সম্পর্কে বিভ্রম থাকা, অপ্রয়োজনীয় উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটি দেশের অর্থনীতির ধসের নিয়ামক। গত এক দশকে জিম্বাবুয়ে, গ্রিস এবং শ্রীলংকার অর্থনৈতিক ধস বিশ্বের তাবত পরিকল্পনাবিদদের চিন্তার দুনিয়ায় মারাক্তকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ধরুন আপনি কোনো দেশে বেড়াতে গেলেন, সঙ্গে করে নিজের ব্যবহারে লাগেজের সঙ্গে এক্সট্রা কয়েকটা বস্তা নিয়ে যাবেন ওই দেশের মুদ্রা বহনের জন্য। কেনইবা নেবেন না, যদি আপনাকে এক বোতল পানি ক্রয় করতে ১ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়! হ্যাঁ জিম্বাবুয়ের কথাই বলছি। ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার আগে দেশটির নাম ছিল সাউদার্ন রোডেশিয়া। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর রোডেশিয়ান ডলার বিলুপ্ত হয় এবং স্বাধীন দেশটি ‘জিম্বাবুয়েন ডলার’ চালু করে। জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি তখন অনেক ভালো ছিল। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত গম এবং তামাকজাত পণ্য। আর জিম্বাবুয়ের মাটি ছিল উর্বর। শুনে অবাক হবেন, ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর জিম্বাবুয়ের ডলারের মান মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা অর্জন থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশটি অগ্রগতি আশাব্যঞ্জ্যক। ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মাঝে বেশকিছু ইকোনমিক রিফর্ম বা সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। কৃষি খাতে মুগাবের চরম অব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক ধসের এক অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯২ সালের ‘ভ‚মি অধিগ্রহণ আইন’-এর আওতায় শ্বেতাঙ্গদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি আওতায় তা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে এই আইনের বিরোধীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর ফলে ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জিম্বাবুয়ের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়, একই সঙ্গে শিল্প উৎপাদনও ৩০ শতাংশ কমে যায়। সমালোচকদের দাবি ছিল, জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার পর গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা বণ্টনের পরিবর্তে তিনি নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের ওই সবের দায়িত্ব দেন। দ্রæতই জিম্বাবুয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা দেশগুলোর একটি থেকে দ্রæত বিদেশি ঋণনির্ভর দেশে পরিণত হয়। ব্যাংকতগুলোয় তারল্য না থাকায় একদিকে শিল্প খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছিল না, অন্যদিকে কৃষকরাও ঋণ পাচ্ছিলেন না। তখন শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক লোক বেকার হয়ে পড়ে। তখন প্রায় ৮০ শতাংশ লোক বেকার হয়ে পড়ে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়। সব মিলিয়ে অর্থনীতির সবগুলো সূচক নি¤œমুখী হতে থাকে। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে যেতে থাকল। আগে যে পণ্য ১০০ জিম্বাবুয়ান ডলার দিয়ে ক্রয় করা যেত, সেটি ক্রয় করতে ব্যয় হচ্ছিল ১০ হাজার জিম্বাবুয়ান ডলার। জিম্বাবুয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অবস্থার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দায়ী দোষারোপ করে। কারণ সেসময় জিম্বাবুয়ের ওপর এই দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ে কংগোতে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় মূলত এই যুদ্ধ থেকে জিম্বাবুয়েকে বিরত রাখতেই দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে আমেরিকা এবং ইউরোপনীয় জোট। যেকোনো দেশের অর্থনীতির মূলকাঠামো টেকসই করতে হলে শিল্পোৎপাদনের কাঁচামালের স্থানীয় জোগান বৃদ্ধি করা, মুদ্রাস্ফীতির হার সহনীয় রাখা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস না পাওয়া, জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সাধারণ মানের ওপরে না যাওয়া ইত্যাদি। এক্ষেত্রে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি সব রেকর্ড ভেঙে গিয়েছিল। ফলে দেশটির আর্থিক কাঠামোতে অবিশ্বাস্য ধকল লাগে। তারা বারবার অর্থনীতিতে বিভিন্ন রিফর্ম করার চেষ্টা করতে থাকে, নতুন নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে। কারণ তাদের দেশীয় মুদ্রার ওপর জনগণের বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুগাবের পরবর্তী বর্তমানে জিম্বাবুয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাদের প্রবাসী লোকজন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছে। এর ফলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন সমৃদ্ধ হচ্ছে। তারপরও বর্তমানে জিম্বাবুয়ের মোট জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের হার ৭৭ শতাংশ, বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি হার প্রায় ১৩২ শতাংশ, বেকারত্বের হার ৫.৭ এবং মাথাপিছু আয় ১২১৪.৫ ডলার জিডিপি বৃদ্ধির হার-৬.২% মোট জিডিপি ১৮.০৫ মার্কিন ডলার (সূত্র: বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০)।

গ্রিস: ঠিক কবে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গ্রিসের জš§ হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক গ্রিক নাগরিক মনে করেন, ১৮২৭ সালের পহেলা মে ত্রোজানে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় অধিবেশনের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গ্রিস আত্মপ্রকাশ করে। তবে ১৮৩০ সালের ৩ ফেব্রæয়ারির আগে ইউরোপের কোনো বড় শক্তি সার্বভৌম দেশ হিসেবে গ্রিসকে স্বীকৃতি দেয়নি। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, ১৮২৩ সালের ৩০ নভেম্বর দেশটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জš§ লাভ করেছিল। কারণ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্যরা স্বীকৃতি না দিলেও গ্রিকরা এদিনই বিরাট এক ঋণ গ্রহণ করেছিল। গ্রিকরা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ব্রিটিশ ব্যাঙ্কার সমিতি থেকে ওইদিন গ্রিস ৮ লাখ পাউন্ড ঋণ নেয়, যার একটি বড় অংশ অস্ত্র ক্রয় কাজে ব্যয় করা হয়। এর চার বছর পর অদৃশ্য গ্রিস রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, দেউলিয়াত্বের কারণে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ১৮৯৩ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চ্যারিলোস ট্রিকৌপিস গ্রিসকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক থ্যানোস ভার্মিস বলেন, প্রধানমন্ত্রী ট্রিকৌপিসের সময় যে কারণে গ্রিস দেউলিয়া হয়েছিল তার সঙ্গে দ্বিতীয় দেউলিয়াত্বের কারণ একেবারেই ভিন্ন ছিল। তার মতে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের অর্থ ১৮২১ সালের বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে ব্যবহƒত হয়েছিল। সে সময় কাগজে-কলমে গ্রিস দেশটির অস্তিত্বই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী চ্যারিলোস ট্রিকৌপিসের সময়ের দেউলিয়াত্ব অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের ফলে সৃষ্টি হলেও গ্রিসের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঋণের অর্থ ব্যবহƒত হয়েছিল। তার সময়ে তৈরি হওয়া রেলপথগুলো এখনও গ্রিসে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৩২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইলেফথেরিয়স ভেনিজেলস অর্থনৈতিক অবনতি এবং স্বর্ণ ও পাউন্ডের বিপরীতে গ্রিক ড্রকমার অবমূল্যায়নের পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই  প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ থ্যানোস ভার্মিস বলেন, ইলেফথেরিয়স ভেনিজেলোস ও প্যানাজিস স্যাল্ডারিসের সময়কালীন দেউলিয়াত্বের ফলে গ্রিস অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ উন্নয়নে নজর দিতে বাধ্য হয়। নিজস্ব স্বনির্ভরতার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষজন উভয় সময়ই সংকটজনক পরিস্থিতির বাইরে ছিল। শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাই ছিল সমস্যার প্রকৃত ভুক্তভোগী, যাদের সংখ্যা আজকের তুলনায় খুবই কম ছিল। গ্রিসের সেই সময়কার নাজুক আর্থিক পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল মূলত ভারী শিল্পের অনুপস্থিতি, অতি সামান্য রপ্তানি আয় ও পর্যটনের অনুপস্থিতি। কালের বিবর্তনে জাতীয় লাভের অনুপস্থিতি ও শহুরে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের ফলে গ্রামাঞ্চলের স্বনির্ভর মানুষের সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে গ্রিসের দেউলিয়াপনা গ্রিকদের অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। ১৯৮১ সালে গ্রিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়।

১৯৯৬ সালে গ্রিস অলিম্পিক গেমস আয়োজন ও ইউরো জোনে প্রবেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইউরো জোনে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ কাগজে-কলমে ভালো ফল দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। বর্তমানে ইউরোপের অনেক নেতা সে সময় মিথ্যা পরিসংখ্যান দেয়ার জন্য গ্রিসকে দায়ী করেন। তবে সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপ অঞ্চলে অর্থনেতিক গতি বেগবান করার কাজে ব্যস্ত থাকায় গ্রিস ভুল তথ্য দিয়েও তখন পার পেয়ে যায়। ২০০৪ সালের আগ অবধি গ্রিস অর্থনীতি একটি কৃত্রিম সমৃদ্ধির বুদ্বুদের ওপর ভেসেছিল। গ্রিসের রাজপথে ছিল নতুন গাড়ির ছড়াছড়ি, ক্রেডিট কার্ড আর সহজ শর্তের ঋণের কারণে গ্রিকরা হয়ে উঠেছিল অতিমাত্রায় বিলাসী। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, গ্রিসের ব্যাংকগুলো লোকজনকে অবসর বিনোদনের জন্যও যে কাউকে ঋণ দিতে শুরু করল। গ্রিসের আর্থিক সংকট গোটা দুনিয়ায় প্রভাব ফেলেছে, পরিণামস্বরূপ গ্রিস ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু এই সংকটটা ধীরে ধীরে অনেক সময় ধরে ঘটেছে। এই আর্থিক সংকটের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল গ্রিক সমাজব্যবস্থার ওপর। ২০১২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ২০ হাজারের বেশি গ্রিক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এথেন্স নগরীর ২০ শতাংশের বেশি দোকান খালি ছিল। ২০ শতাংশ গ্রিকের নাগরিক দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। এই গৃহহীনতার সমস্যা তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সরকার কোনোভাবেই তাদের আর্থিক সাহায্য দিতে সক্ষম হচ্ছিল না।

অনিয়ম অব্যবস্থাপনা, তথ্য গোপন ইত্যাদি গ্রিক অর্থনীতি ধসের অন্যতম কারণ ছিল। শুধু যে আর্থিক/ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো গুলি কারচুপি করত তাই নয়, সরকারি মদদেও কারচুপি সংগঠিত হতো। ২০১০-এর শুরুতে দেখা গেছে যে গ্রিক সরকার গোল্ডমান সাক্স ও অন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষাধিক টাকার ফিস দিয়েছে শুধু তাদের প্রকৃত ঋণের তথ্য গোপন করতে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রস কারেন্সি স্বপ (পৎড়ংং পঁৎৎবহপু ংধিঢ়) যেখানে কোটি কোটি টাকার গ্রিক ঋণ ডলার অথবা ইএনে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল একটি ভুল এক্সচেঞ্জ রেটে কারনে। ঋণ করে রাষ্ট্র যে দেউলিয়া হতে পারে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ গ্রিস ও শ্রীলঙ্কা। গ্রিসের বৈদেশিক ঋণ দেশটির মোট জিডিপির ১৭৭ শতাংশ আর ৩২ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গ্রিসের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ইউরোই দায়ী। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় এই মুদ্রা ব্যবস্থা। ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পূর্বে ঋণদাতা গোষ্ঠী গ্রিসকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করত। ফলে এখানে অতিরিক্ত অর্থলগ্নিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করত। কিন্তু ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে আর বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করেনি। ঋণদাতা গোষ্ঠী তখন দেশটিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিতে শুরু করে। সে সময় ঋণদাতারা দেশটিকে মধ্য আয়ের দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে তারা জার্মানিকে যে সুদে ঋণ দিয়েছে, সেই একই হারে গ্রিসকেও ঋণ প্রদান করে। ভুল তথ্য, কাল্পনিক চিন্তা অবিবেচনা প্রসূত উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ (যেসব প্রকল্পে প্রচুর বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয়) দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। যে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে গ্রিসকে। বৈদেশিক ঋণের সাগরে ভাসতে থাকা গ্রিসের বর্তমান জিডিপি ১৮৯.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৪৩৬ মার্কিন ডলার। গ্রিস সরকারের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের চ‚ড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ২০১৫ সালের ৫ জুলাই একটি গণভোটের আয়োজন করে এবং গণভোটে না পক্ষ বিজয়ী হয়। এ গণভোটের বা ন্যায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশটির জনগণ ঋণদাতাদের দেয়া কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের শর্ত সংবলিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব (বেইল আউট) প্রত্যাখ্যান করে। বেইল আউট হলো কোনো দেশকে দেয়া আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির নাম। গ্রিস বর্তমানে ধীরে ধীরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকার সমস্যা অনেকটা লাগব করে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থনীতি রিফর্ম এবং কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে দেশেটি বর্তমানে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। 

শ্রীলংকার চলমান সংকট এর বিষয়ে কমবেশি সবারই জানা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনও এতটা দুরবস্থায় পড়েনি দেশটি। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয়ও ঠিকঠাকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া (সূত্র: বিবিসি)। গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, বড় বড় রাস্তা নির্মাণ, নতুন শহর এবং আরও নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরতেœ বলেন, কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলঙ্কার জন্য ‘শ্বেতহস্তীতে’ রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। অধ্যাপক আবিরতেœ বলেন, গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্য। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সংকট ছাড়াও বিদ্যুৎহীনতার মধ্যেই কাটছে শ্রীলঙ্কানদের। ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর প্রাণ ফিরে এসেছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, জমজমাট হয়ে উঠছিল পর্যটনসহ সেবা খাত। সমালোচকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সংকটের মূলে রয়েছে বিগত কয়েকটি সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। উচ্চাভিলাষী মেগা প্রকল্প, দুর্নীতি, সঠিক যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটি রাষ্ট্রকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে তার বড় উদাহরণ এই দেশটি। দেশের বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার না হলে রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হয়। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত দেশটির রিজার্ভ ছিল মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২২ সালে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের মুখোমুখি হতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। যার মধ্যে গত জুলাইয়ে পূর্ণ হওয়া ১ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড (আইএসবি) আছে। শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের বৃহত্তম অংশ আইএসবি। যার পরিমাণ ১২.৫৫ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণদাতাদের মধ্যে আছেÑএশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান এবং চীন (সূত্র : ডেইলি স্টার)। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ছিল, তাদের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি দিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম পা রাখা শ্রীলঙ্কা নির্ভরশীল ছিল পর্যটনেও। শিক্ষিতের হার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি ছিল এবং সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল সবার চেয়ে সামনের কাতারে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার হয়, যা প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি দেশটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে শ্রীলঙ্কা ক্রমেই পেছাতে শুরু করে। এমনকি আশির দশকে বাংলাদেশে যে তৈরি পোশাক শিল্প অগ্রযাত্রা সেটি সম্ভব হয়েছিল বিনিয়োগকারীদের শ্রীলঙ্কা থেকে সরে আসার কারণে। ক্রেতারা মূলত শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটিতে বিনিয়োগ করতে ভয় করার কারণেই, পরবর্তী সময়ে চেষ্টা করেও শ্রীলংকা সেই অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য, অনেক শ্রীলঙ্কান বায়িং হাউস বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করে এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রীলঙ্কানদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। উপমহাদেশের কোনো একটি দেশে কোনো নেতিবাচক প্রভাব বা পরিবর্তনের হাওয়া লাগলে তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে কমবেশি পড়ে থাকে। বাংলাদেশকে সতর্ক হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ তথা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাবিদরা। মূলত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ, বৈদেশিক রেমিট্যান্স, সস্তা শ্রম এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের ভালো রিপোর্ট আমাদের অর্থনীতিকে একটি স্বস্তির জায়গায় রেখেছে। ক্রমবর্ধমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব পদ্মা ও রূপপুরের মতো বাস্তবিক মেগা প্রকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের আরও দূর বহুদূর নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। যেহেতু অনেকেই বর্তমানের এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করে থাকেন বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা অর্থনীতির তুলনামূলক অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে  শ্রীলঙ্কার মোট ঋণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যেহেতু দেশটির মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ, সে হিসাবে শ্রীলঙ্কা মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট ঋণ ৪৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার। যেহেতু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ, সে হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২.১১ ডলার। বাংলাদেশের চেয়ে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় ছয় গুণ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে শ্রীলঙ্কার রেমিট্যান্স ছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। একই অর্থবছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ছিল ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা শ্রীলঙ্কার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয় কমে যাওয়াকে বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি আয় শ্রীলঙ্কার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। মার্চ ২০২২ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪.৪০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ শ্রীলঙ্কার চেয়ে ২২ গুণ বেশি। ‘অর্গানিক কৃষি’ চালুর কারণে শ্রীলঙ্কা কৃষিজ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, সে পথে না হেঁটে বরং বাংলাদেশ ক্রমেই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল, কিছু ঝুঁকির কথা অনেক অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করছেন, যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার। যখন কোনো দেশের অর্থনীতি ভালো করতে থাকে, তখন সেদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদি এসবের রাশ টেনে ধরা না যায়, তা সমৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ও এর ব্যতিক্রম হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুসাহিত করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এমন কিছু যেন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে এই বিষয়টি খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। যদি বাংলাদেশ এই বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় বা বাধাগস্ত হয়, সেটি বাংলাদেশকে আবার অনেক পেছনে নিয়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ অব্যাহত রেখে এবং ঋণ গ্রহণে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে যে কোনো সংকট মোকাবিলা করে দেশ এগিয়ে যাবে।

উপপরিচালক, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং

জোনস অথারিটি (বেপজা)

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা