কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের ইন্তেকাল

নিজস্ব প্রতিবেদক: একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তার একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান জানান, তার মা রিজিয়া রহমান বেশ কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তার কিডনি একদমই কাজ করছিল না। হার্ট দুর্বল ছিল। এছাড়া গত বছর থেকে তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন। তিনি চিকিৎসার মধ্যেই ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ১৫ আগস্ট তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তার আর ফেরা হয়নি। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
বাদ আসর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের মসজিদে রিজিয়া রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে মিরপুর সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হবে।
রিজিয়া রহমানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শোক প্রকাশ করে। শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, লেখক-গবেষক ও নারীনেত্রী মালেকা বেগম প্রমুখ।
ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে রিজিয়া রহমানের বিচরণ। রাজধানীতে বসবাস করলেও তিনি নিজেকে সবসময় নাগরিক কোলাহল থেকে মুক্ত রেখেছেন। নির্মোহ জীবন কাটিয়েছেন। তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘উত্তর পুরুষ’, ‘রক্তের অক্ষর’, ‘বং থেকে বাংলা’।
রিজিয়া রহমান ‘অভিবাসী আমি’ ও ‘নদী নিরবধি’ নামে দুটি আত্মজীবনী লিখেছেন।
উপন্যাসে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন রিজিয়া রহমান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
রিজিয়া রহমান ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতার ভবানীপুরে জš§গ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তা পারিবারিক নাম ছিল জোনাকী। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা মরিয়াম বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশে রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। ১৯৫০ সালে তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তার লেখা গল্প ‘টারজান’ সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়। ১৯৫২ সালে বাবার মৃত্যুর পর তারা ঢাকার শাইনপুকুরে নানাবাড়িতে চলে আসেন।
১৯৬০ সালে দীর্ঘদিন পর দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় রিজিয়া রহমানের লেখা গল্প ছাপা হয়। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয় তার লেখা কবিতা। ১৯৬৭ সালে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতার সম্পাদক কামরুন নাহার লাইলির উৎসাহে তিনি ‘লাল টিলার আকাশ’ নামক গল্প লেখেন। পরে ললনা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন।
বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে চলে যান রিজিয়া রহমান। সেখানে কোয়েটা গভর্নমেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছর লেখাপড়া করেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট-সম্পর্কিত জটিলতার কারণে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়নি। এ কারণে তিনি দেশে ফিরে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা ত্রিভুজ-এর সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্য পরিচালক হিসেবে। তিন বছর বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
শৈশব থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রিজিয়া রহমানের কবিতা ও গল্প ছাপা হলেও তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ গল্পগ্রন্থে থাকা ‘লাল টিলার আকাশ’ গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ অশ্লীলতার অভিযোগে ছাপাতে নারাজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পাদনা বোর্ডকে রাজি করিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। পরে ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তার ‘ঘর ভাঙা ঘর’ ছাপা হয়, যা বই আকারে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। বস্তির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিয়ে রচিত এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তার ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারির চিত্র তুলে ধরেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস।
নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময় খুলনা অঞ্চলের বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাথা নিয়ে রিজিয়া রহমান লিখেছেন ‘অলিখিত উপাখ্যান’। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘বাঘবন্দি’ উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন বঞ্চনা থেকে মুক্তি আবশ্যকতা। প্রাচীন নগরীতে যাত্রা উপন্যাসে তিনি লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন। ‘অভিবাসী আমি’ তার আত্মজীবনীমূলক প্রথম বই। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। তার দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই ‘নদী নিরবধি’ ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি তার শৈশবের পাশাপাশি লেখক জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন।
পারিবারিক জীবনে রিজিয়া রহমান মো. মীজানুর রহমানের সহধর্মিণী। মীজানুর রহমান ছিলেন একজন খনিজ ভূতত্ত্ববিদ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০