কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে নিহত ৪৫, আহত দুই শতাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানিবাহী কনটেইনার রাখার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপো। এ ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয় এবং দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এর মধ্যে ৩২ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। আর আমদানি ও রপ্তানিবাহী কনটেইনার, যন্ত্রপাতি, ট্রাক, ট্রেইলারসহ প্রাথমিকভাবে ১২০ মিলিয়ন ডলারেরও (১০৮০ কোটি টাকা) বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানা যায়, সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে শীতলপুর এলাকায় প্রায় ৩০ একর জমিতে গড়ে ওঠা বিএম কনটেইনার ডিপোতে ৫০০ মিটারের একটি টিন শেডের ভেতর রপ্তানির জন্য মজুত ছিল বিপুল পরিমাণ দাহ্য রাসায়নিক ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্যও এ ডিপোতে রাখা আছে। শনিবার রাতে আগুন লাগার পর রাত ১১টার দিকে সেখানে কয়েক দফা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।

এ সময় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাইরে ছড়িয়ে যায়। গতকাল সকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসব রাসায়নিক যাতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। ঘটনাস্থলে রপ্তানির জন্য ৮০০ টিইইউ’স বোঝাই তৈরি পোশাক এবং আমদানিকৃত ৫০০ কনটেইনার হিমায়িত খাদ্যপণ্য ছিল। আর খালি কনটেইনার ছিল ৩ হাজার। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) কর্তৃপক্ষ। 

বিকডার তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানির জন্য ৮০০ টিইইউ’স (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার) বোঝাই তৈরি পোশাক এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্য ছিল। আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই কনটেইনার ছিল ৫০০টি এবং খালি কনটেইনার ছিল ৩ হাজার। বিকডার সচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, আমরা ধারণা করছি, প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি কনটেইনারে ৪৫ মিলিয়ন ও আমদানি পণ্যের কনটেইনারের ক্ষেত্রেও ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি এবং অন্তত ২০ মিলিয়ন ডলারের খালি কনটেইনারের ক্ষতি হয়েছে। আর সঠিক লোকসানের পরিমাপ নিরূপণে আমরা এখনও এটি নিয়ে কাজ করছি।

ডিপো শ্রমিক সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে দুই শিফটে প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। আর ৩০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডিপোটির কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৫০০ টিইইউ’। এর মধ্যে শনিবার ডিপোটিতে চার হাজার ৩০০ টিইইউ’স (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার) রপ্তানি, আমদানি এবং খালি কনটেইনার ছিল। এর মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানির জন্য এখানে ১২০ কনটেইনারের মতো পণ্যের চালান বোঝাই করা হয়েছে। যেগুলো মার্কিনভিত্তিক চেইন ক্লথ ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইউরোপীয় ব্র্যান্ডকে পণ্য পাঠানোর কথা ছিল। এছাড়া ডিপোতে প্রাণ গ্রæপের রপ্তানি পণ্য ছিল।

গতকাল রোববার সকাল নয়টার দিকে বন্দর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি দল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে। বেলা ১১টা পর্যন্ত তারা ডিপো পরিদর্শন করে। এ সময় ডিপোতে আগুন জ্বলছিল। ডিপোতে এখনো অক্ষত থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডসহ রাসায়নিক পণ্যভর্তি কয়েকটি কনটেইনার সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেন বন্দর চেয়ারম্যান। মালিকপক্ষ ও কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম বন্দরের যন্ত্রপাতি দিয়ে কনটেইনার সরিয়ে দেয়ার কথা বলেন। বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডবাহী ২৬টি কনটেইনার ছিল। ডিপোর টিনশেডেও প্লাস্টিকের জারে এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে পানি ও আগুনের সংস্পর্শে কনটেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেইনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে স্পিøন্টারের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে।

ডিপোতে থাকা রপ্ততানি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটা নোটিস জারি করেছি, যাতে আমাদের সদস্য যাদের পণ্য সেই ডিপোতে ছিল তারা যেন তথ্য দেয়। সেইটি আসলে সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া যাবে। তবে আমরা অনুমান করছি প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মূল্যের রপ্তানি পণ্য একেবারেই পুড়ে গেছে। আমরা এ ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নিচ্ছি। পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’

এ বিষয়ে বিএম কনটেইনার ডিপোর মুখপাত্র শামসুল হায়দারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে স্মার্ট গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোর রিসিভ করেননি।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় চট্টগ্রাম জেরা প্রশাসক মমিনুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যও রয়েছেন। এর মধ্যে ৩২ জনের লাশ শনাক্ত হয়নি। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৪৬ জন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সংকটাপন্ন ৮ রোগীকে হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশসেরা চিকিৎসক ডা. সামন্ত লাল সেন ও তার টিম আগামীকাল (সোমবার) সকালের প্রথম ফ্লাইটে চট্টগ্রামে এসে রোগীদের চিকিৎসার কাজ শুরু করবেন। এছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২ লাখ টাকার চেক দেয়া হবে। আজ (গতকাল) ১৩ জনের পরিবারকে এই টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে নিহতদের ৫০ হাজার ও আহতদের ২৫ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেড একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে ২০১১ সালের মে মাসে। ১১ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি ও আমদানি কনটেইনারাইজড কার্গো থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির ডাচ নাগরিক বার্ট প্রঙ্ক কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের যৌথ মালিকানাধীন আবাসন প্রতিষ্ঠান সিটি হোম প্রপার্টিজ লিমিটেড, বিএম এলপি লিমিটেডসহ পোশাক খাতের একাধিক কোম্পানি আছে। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের ভাইদের সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ে সমআর্ট গ্রুপ নামে আরও একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তার বড় ভাই শফিকুর রহমান ও ছোট ভাই মুজিবুর রহমান স্মার্র্ট গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদে রয়েছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০