সম্প্রতি বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়বস্তু-সমেত ব্লগ ও ভিডিও তৈরিকারক বাড়ছে। ব্যবহারকারীদের বিনোদন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নির্মাতারাও পাচ্ছে আয়ের সুযোগ। সৃজনশীলতার এ সময়ে একজন বিষয়বস্তুভিত্তিক ভিডিও নির্মাতার সৃজনশীল কার্যক্রমকে কোনো মানদণ্ড দিয়ে যাচাই-বাছাই করা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। এখন প্রশ্ন হলো বিষয়টি যৌক্তিক না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুভিত্তিক বিভিন্ন ভিডিও নির্মাণে কেন বাড়ছে রুচিশীলতার প্রশ্ন? সামাজিক মাধ্যমে আদৌ কি অসামাজিক ভিডিও কনটেন্ট বাড়ছে? এসব প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, হ্যাঁ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়ছে অসামাজিক ভিডিওর সংখ্যা। নির্মাতাদের নির্মিত ভিডিওগুলোর একটি বিরাট অংশই রুচিসম্মত নয়। রুচিহীন এসব ভিডিও নির্মাণে দায়ী কারাÑএমন প্রশ্নের জবাবেও বলতে হয়, এটির প্রথম দায় বর্তায় নির্মাতা ব্যক্তি ও নির্মাণে সহযোগিতাকারীদের ওপর। এ প্রশ্নের উত্তরের পর হয়তো আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারেÑকুরুচিপূর্ণ ভিডিও নির্মাণে দায় কী একটি পক্ষের? না, এ দায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দেশীয় সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা সরকার কেউই এড়াতে পারে না। মূলত মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকে সমাজের দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে দর্পণ বা আয়নায় সমাজের ভালো-মন্দ, আলো-আঁধারির নাগাল পাওয়া যায়। এই মিডিয়া অর্থাৎ মাধ্যমে প্রাপ্ত ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক আলোই প্রতিফলিত হয় মানুষের জীবেনে। জাগ্রত হয় মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত বিষয়ে রুচিবোধÑহোক সেটা নেতিবাচক অথবা ইতিবাচক কোনো বিষয়। আয়নায় খাদ তৈরি হলে যেমন অস্বচ্ছ প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনই আমাদের জানার ও বিনোদনের এসব মাধ্যমে অপসংস্কৃতি ও কুরুচিপূর্ণ বিষয়বস্তুভিত্তিক ভিডিও দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকলে সেটির ইতিবাচক প্রতিফলন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফলে এমন অসম্পূর্ণতা সমাজে বসবাসরত মানবমহলে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সৃজনশীলতাকে যদিও আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা অনুচিত, তবুও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বন্ধ করায় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বলছে, ডিজিটালাইজেশন ও বিশ্বায়নের এই সময়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত। তবে সহজে পাওয়া এই ইন্টারনেটে বিষয়বস্তুভিত্তিক ভিডিও নির্মাতা হয়ে ওঠা তার থেকেও সহজ। দেখা যায়, কোনো তথ্য না জেনেই সেটির বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করে দিচ্ছে অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে তেমনই একটি ভাইরাল ভিডিও নজরে আসে আমাদের। যেখানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নমনীয় বলছেন একজন নির্মাতা। মূলত হাতের কাছে একটি স্মার্টফোন ও সময় থাকলে যে কেউই যে কোনো বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বিশারদের মতো ভিডিও তৈরি করে মুহূর্তের মধ্যেই তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারেন। সহজলভ্যতার দরুন নির্মাতাদের অনেকেই ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা ও চালচলন দেখিয়েও ভিডিও নির্মাণ করছেন অনেক নির্মাতা। সোশ্যাল প্লাটফর্মে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতেই তৈরি হয় এ ধরনের কনটেন্ট, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এসব কুরুচিপূর্ণ ভিডিও ছাড়াও যে রুচিশীল ভিডিও তৈরি করা যায়, সেটিও অজানা অধিকাংশ নির্মাতার। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিবিষয়ক ভিডিও তৈরিতে অনাগ্রহী অধিকাংশ নির্মাতা। অধিক ভিউজ পেতে অশ্লীলতার স্রোতে ভাসছেন অনেকে। তবে রুচিসম্মত ভিডিও যে তৈরি হয় না তা কিন্তু নয়। কুরুচিপূর্ণ ভিডিওর ছড়াছড়িতে রুচিসম্মত কনটেন্ট পার করতে হয় নাজেহাল অবস্থা। কেমন করে বাড়ল নির্মাতা ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও কনটেন্ট? আসা যাক সে আলোচনায়। ২০২০ সালের প্রারম্ভে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে মহামারি করোনাভাইরাস। সবাই হয়ে পড়ে ঘরবন্দি। চারদেয়ালে আবদ্ধ জীবনে বিনোদন চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেকেই শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল ও ইন্টারনেট ব্রাউজিং। একটি অংশ ঝুঁকে পড়ে ভিডিও নির্মাণে। তবে বিশ্বের অনেক দেশ মহামারি পরিস্থিতিতে সামাজিক কনটেন্ট তৈরি শুরু করলেও বাংলাদেশে দেখা যায় তার ভিন্ন চিত্র। টিকটকের মতো একটি প্লাটফর্মের কথাই ধরা যাক। চায়না যেখানে টিকটক ব্যবহার করছে, তাদের শিক্ষা বিস্তার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দৃশ্যপট বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য। সেখানে বাংলাদেশে চলছে অশালীন টিকটক ভিডিও তৈরির হিড়িক। ২০২০ সালের পর থেকে টিকটক ভিডিও নির্মাণ করে কুখ্যাতি অর্জন করেছে দেশের অনেক টিকটকার। তৈরি হয়েছে রুচিহীনতার কোলাহল। ফলে মিডিয়ায় রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে বলেও মন্তব্য করতে দেখা গেছে অনেককে।
দেখা যায়, ফেসবুক বা ইউটিউবে যেসব কনটেন্ট নির্মাণ করা হয়, সেগুলোর একটি বিরাট অংশের মান ও রুচি নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। এসবে অশ্লীল ভাষা, অসংগতিপূর্ণ ইতিহাস, ধর্মীয় ও সামাজিক উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রাচুর্য দেখা যাচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক এসব নির্মাতার অধিকাংশই স্কুল-কলেজপড়ুয়া তরুণ-তরুণী। আবার একটি অংশের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে অকাজের বেলায় দুপক্ষই সমান। ভিডিও নির্মাতাদের যে অংশ রুচিশীল ভিডিও তৈরি করেন তারা দেশে ইতিবাচকভাবে জনপ্রিয়। তার বিপরীতে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও নির্মাতাদের কর্মকাণ্ড দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সৃজনশীল উপায়ে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও নির্মাণ করলেও এক্ষেত্রে তারা পরিত্যাজ্য। সর্বোপরি বলতেই হয়, কুরুচিপূর্ণ এসব ভিডিও নির্মাতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই।
জিহাদ হোসেন রাহাত
শিক্ষার্থী
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ