Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:59 pm

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালে দেশব্যাপী চলছে মুক্তিযুদ্ধ। রক্ত ঝরছে রণাঙ্গনে। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করছে। তারা নির্বিচারে হত্যা করছে সাধারণ মানুষকে। অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানি, শিশুহত্যাসহ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী। জীবন বাঁচাতে প্রায় কোটি মানুষ দেশ ছেড়েছে। তারা আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বিশ্ববাসীও সঠিক চিত্র পাচ্ছে না। সামরিক বাহিনী বল প্রয়োগ করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার খবর সাংবাদিকরাও স্বাধীনভাবে সংগ্রহ করতে পারে না। তাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আসছে না সঠিক সংবাদ। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজনমত গঠনে।

এদিকে জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা আরেক মানবিক বিপর্যয়ের মুখামুখি। শরণার্থী শিবির খুলে ভারত সরকার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু তাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার মতো অতি প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারের কাছে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা দেখা দেয় এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচানো। এসব সমস্যা নিয়েই পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত বাঙালি কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর তার বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আলাপ করেন। রবিশঙ্কর যুক্তরাষ্ট্রে একটি কনসার্ট আয়োজনের জন্য হ্যারিসনকে প্রস্তাব দেন। এ কনসার্ট হবে বাংলাদেশের জন্য এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য। কনসার্টের অর্থ শরণার্থীদের ত্রাণ হিসেবে দান করা হবে। জর্জ হ্যারিসন প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করেন। উদ্যোগ নেন এই কনসার্ট আয়োজনের। তার বিখ্যাত সংগীত দল ‘দ্য বিটলস’ এরই মধ্যে ভেঙে গেছে। তিনি ‘ব্যাড ফিঙ্গার’ নামে নতুন দল গঠন করেছেন। তারপরও হ্যারিসন প্রথমেই তার ভেঙে যাওয়া দ্য বিটল্?সের সদস্যদের কনসার্টে যোগ দিতে অনুরোধ জানান। নানা কারণে ভেঙে যাওয়া দলের সবাই যোগ দেননি, তবে রিঙ্গো স্টার যোগ দিতে সম্মত হন। আরও সম্মতি জানান বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন এবং হ্যারিসনের নতুন দল ব্যাড ফিঙ্গারের যন্ত্রীদলসহ অনেকেই। অনুষ্ঠান আয়োজন এবং সবদিকে গুছিয়ে নিতে সময় নেয়া হয় পাঁচ সপ্তাহ।

পহেলা আগস্ট, রোববার ১৯৭১, বেলা ২টা ৩০ মিমিনট ও সন্ধ্যা ৮টায় নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এদিন সাবেক দ্য বিটল্স সংগীতদলের লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় বিখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্করের আয়োজনে দুটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শুরু করা হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আলি আকবর খানের যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে। তাদের সঙ্গে তবলায় বাজান ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। তারা ‘বাংলা ধুন’ নামে একটি ধুন পরিবেশন করেন। বিটল্স ভেঙে যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে হ্যারিসন সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। প্রায় পাঁচ মাস পর এরিক ক্ল্যাপটনও এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গাইলেন। বব ডিলন ১৯৬৯ সালের পর শ্রোতা-দর্শকদের উপস্থিতিতে কোনো সংগীত পরিবেশন করেননি। এদিন বব ডিলনও প্রথমবারের মতো শ্রোতা-দর্শকদের সামনে এলেন। দুটি অনুষ্ঠানে তারা গানগুলো ভিন্নক্রমে পরিবেশন করেন।

ম্যাডিসন স্কয়ারের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান, ‘মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ থেকে শুরু করে তার লেখা ও সুরারোপিত ৫০ লাইনের বিখ্যাত গানÑ‘আ হার্ড রেইন ইজ গোননা ফল’। বব ডিলানের গানের সঙ্গে গিটার বাজান জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টনসহ অনেকেই গান পরিবেশন করেন, গিটার বাজান। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসন লেখেন নতুন গান। অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে গানটি পরিবেশন করা হয়। তাঁর গানটি ছিলÑ‘এলো একদিন বন্ধু আমার/ চোখভরা তার ধু-ধু হাহাকার/ বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা/ দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে/ বেশি কিছু আমি জানতে চাই না।’ আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত সুরের মধ্যে আর্তনাদের মতো করুণ অথচ দৃঢ়কণ্ঠে জর্জ হ্যারিসনের এই গান সেদিন কনসার্টকে আলোড়িত করে, জাগিয়ে তোলে বিশ্ববিবেককে। পুরো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ছাড়াও জর্জ হ্যারিসন একক সংগীত পরিবেশন করেন ছয়টি। এই কনসার্টের মাধ্যমে সাহায্য হিসেবে পাওয়া যায় দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার ৫১ সেন্ট। পুরো অর্থই ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ব্যয় করা হয়।

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ থেকে একটি লাইভ অ্যালবাম, একটি বক্স-থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মস ১৯৭২ সালে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়। লাইভ অ্যালবামটি সর্বাধিক বিক্রয়কৃত অ্যালবাম হিসেবে স্থান করে নেয়। অনুষ্ঠানের গানের একটি সংকলন ১৯৭১ সালে বের করা হয় এবং ১৯৭২ সালে এই অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। ২০০৫ সালে কনসার্টের চলচ্চিত্রটিকে একটি তথ্যচিত্রসহ নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের পাশে বিদেশি বন্ধুদের দাঁড়ানোর মহতী উদ্যোগ ছিল ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সেই ঐতিহাসিক কনসার্টের অন্যতম দুই উদ্যোক্তা ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন। গত বছর কনসার্টের ৫০ বছর পূর্তিতে নিউইয়র্কে আয়োজন করা হয়েছে একটি উৎসবের। ৩১ জুলাই, শনিবার বিকালে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে ‘ফ্রেন্ডস অব ফ্রিডম’ নামে একটি সংগঠন আয়োজন করেছে উৎসবের। সেই কনসার্ট নিয়ে সাংবাদিক শামীম আল আমিনের পরিচালনায় নির্মিত ‘একটি দেশের জন্য গান’ বা ‘সং ফর এ কান্ট্রি’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত শামীম আল আমিনের লেখা ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বইয়ের মোড়কও উšে§াচন করা হয়। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ১৯৭১ সালের কনসার্টে অংশ নেয়া কিংবদন্তি সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খানের বড় ছেলে এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খান অনুষ্ঠানে সরোদ পরিবেশন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু, ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক ও যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। একাত্তরের সেই ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রত্যক্ষদর্শী নিউজার্সির বাসিন্দা দুই বোন লিন্ডা ও ম্যারিয়ন অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ বিসর্জন, দেশের মানুষের ত্যাগ আর বড় শক্তি ছিল বিদেশি বন্ধুদের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা। নিউইয়র্কের পৃথিবীবিখ্যাত মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং পাশ্চাত্য সংগীতের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব জর্জ হ্যারিসনের আয়োজন ছিল অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থানে ছিল। সে দেশের অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও এ কনসার্ট ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তোলে। কনসার্টেও উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীদের সহায়তা দেয়া। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ ও নির্মমতা চলাচ্ছে, সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানানো। ঐতিহাসিক উদ্যোগ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তার উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি সফল হয়, প্রবলভাবে জনমত গড়ে ওঠে বাংলাদেশের পক্ষে। বিশ্ববাসী জানতে পারে, জাতিগত মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য এশিয়ার একটি দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতেÑসেই দেশটির নাম ‘বাংলাদেশ’।

গণমাধ্যমকর্মী