Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 6:18 pm

কপ-২৭ ও বাংলাদেশের প্রত্যাশা

. মতিউর রহমান: জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (টোয়েন্টি-সেভেন্থ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস (কপ-২৭) মিসরের শার্ম আল-শেখ শহরে শুরু হয়েছে। এ মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত সম্মেলনটি চলবে। জাতিসংঘের প্রথম জলবায়ুু সম্মেলন ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত কপ-২১ শীর্ষ সম্মেলনে, সদস্য দেশগুলো ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করে। প্যারিস চুক্তি ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দেশগুলোর কী করণীয় সে বিষয়ে একটি যুগান্তকারী চুক্তি।

এই চুক্তির অধীনে, প্রতিটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্বন নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা এবং অভিযোজন ব্যবস্থা নিয়ে নেয়া পদক্ষেপগুলো প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। দেশগুলো বর্তমান বৈশ্বিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগ স্তরে কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে কমাতে একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। সেই সময়ে, সরকারগুলো বিশ্ব উষ্ণায়নকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার একটি  উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।

কপ-২৭ হলো জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) কনফারেন্স অব দ্য পার্টির ২৭তম সভা। এই বার্ষিক সভাটি ইউএনএফসিসিসি কনভেনশনের ১৯৮টি সদস্য রাষ্ট্রকে একত্র করে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করার জন্য।

সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন (গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস, যা আমাদের গ্রহকে ক্রমবর্ধমান উষ্ণ করে তোলে) নিয়ে আলোচনা করবেন। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবেশগত প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য সম্ভাব্য আরও দুর্যোগ সহনীয় হয়ে ওঠার বিষয়েও আলোচনা করবেন। এছাড়া সহায়তার উপায় চিহ্নিত করার বিষয়ে আলোচনা হবে।

বলা হচ্ছে কপ-২৭ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বৈশ্বিক পদক্ষেপের জন্য একটি করো অথবা মরো (ডু অর ডাই) মুহূর্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবী বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে অক্ষম। আর গত বছরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার পর এই বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক প্রভাব, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং বিভিন্ন দুর্যোগের আকারে জলবায়ু পরিবর্তনের অসহনীয় প্রভাব মোকাবিলা; কার্বন নিঃসরণ হ্রাসসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করেছে। এ অবস্থায় প্যারিস চুক্তি অপ্রাসঙ্গিকতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এই বাস্তবতায় কপ-২৭ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।

গত বছর জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন কিছু বিষয়ে ঐকমত্যের সঙ্গে শেষ হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করা এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর অঙ্গীকার। কপ-২৬ প্যারিস রুলবুক, যা আর্টিকেল ৬ নামে পরিচিত চূড়ান্ত করে, যা কার্বন নিঃসরণ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কপ-২৬ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি হতাশা ছিল। কারণ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো থেকে আর্থিক সহায়তা ত্বরান্বিত করার কথা ছিল; তবে এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। যদিও গ্লাসগো সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে, তবে এটি কাটিয়ে উঠতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই অধিবেশন শেষ হয়।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণÑযেমন খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য বিপর্যয়, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অতিবৃষ্টি এবং অকাল বন্যা প্রভৃতি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসনও প্রকট আকার ধারণ করছে।

শুধু ২০২২ সালে, বেশ কয়েকটি চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত হানে। পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা কমপক্ষে ৩৩ মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারের সহায় সম্পত্তির ক্ষতি করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও তীব্র হচ্ছে। এই বছরের শুরুর দিকে, ব্যাপক বন্যা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকাকে বাস্তুচ্যুত ও ধ্বংস করেছিল। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি করেছিল। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলার মানুষ।

এ অবস্থায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন আমাদের জন্য একটি বাঁচা-মরার বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সেসব দেশের মানুষের জন্য যারা প্রতিনিয়ত চরম আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করছে।

কপ-২৭-এর আগে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিশ্ব নেতাদের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ টেকসই শক্তির ওপর জোর দেয়া; সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; জলবায়ু পরিবর্তনের সব উদ্যোগে নারীর সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের দিকে মনোনিবেশ করা; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বন ও বৃক্ষ সংরক্ষণ; জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সব পরিকল্পনায় স্থানীয় জ্ঞানের ব্যবহার এবং ভুক্তভোগী শনাক্তকরণে স্থানীয় সম্পৃক্ততা; মৌলিক মানবাধিকারের ন্যায় মৌলিক জলবায়ু অধিকার প্রণয়ন; জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং পরিবেশের পরিকল্পিত ধ্বংসকে ‘ইকোসাইড’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য, পরিসংখ্যান ও সমীক্ষার ফলাফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং সরকারকে শক্তিশালী করা এবং দূষণকারী বহুজাতিক কোম্পানির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রভৃতি।

অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ (টিআইবি) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ আদায়ে কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনের রোডম্যাপের ঘোষণায় সম্মত হওয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

কভিডের প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং উন্নত দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর দ্বারা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে রাজি করাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত  দেশগুলোকে একত্রে সোচ্চার হতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী বন্যা, সুনামি, ঘূর্ণিঝড় এবং দাবানলের মতো ঘটনা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। যা-ই হোক, কার্বন নির্গমনকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কয়লাভিত্তিক শক্তি প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সোচ্চার হতে হবে।

উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েও ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর জলবায়ু অর্থায়নে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও জলবায়ু তহবিল উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘নতুন’, তবে যাচাই-বাছাই ছাড়াই উন্নয়ন সহায়তার সঙ্গে জলবায়ু অর্থের সমন্বয় করে বিগত দুই বছরে মাত্র ৮৩.৩ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে সর্বাধিক ২০ বিলিয়ন জলবায়ু তহবিল।

উন্নত দেশগুলোর বাধার কারণে ২০২১ সালের জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা তহবিল গঠন করা সম্ভব হয়নি। পরিবর্তে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমের জন্য অর্থায়ন হ্রাস করা হয়েছে। প্যারিস চুক্তির আলোকে আসন্ন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, প্রশমন ও অর্থায়নের ওপর জোর দিতে হবে এবং বাংলাদেশ ও অন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থেই জোরোলো ভূমিকা রাখতে হবে।

প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু অর্থায়নের একটি সর্বসম্মত সংজ্ঞা না থাকাই ‘নতুন’ এবং”অতিরিক্ত সহায়তাও ঋণ হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে; কারণ এ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থের ৭০ শতাংশই ঋণের আকারে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন বরাদ্দ এখন আর পর্যাপ্ত নয়।

এ অবস্থায় ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক জলবায়ু তহবিলের প্রয়োজন হবে ১৪০ থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। তাই ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অভিযোজন এবং প্রশমনের চাহিদা মেটাতে অর্থায়নের জন্য নতুন সম্মিলিত লক্ষ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

গবেষক ও উন্নয়নকর্মী