সালমা আফরোজ: ফেনীর সদর উপজেলার মেয়ে ৩১ বছর বয়সী সামায়রা খাতুন। তার শ্বশুরবাড়ি তাদের বাড়ির পাশেই। তিনি এখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। করোনাভাইরাসজনিত রোগের (কভিড) এ সময় তিনি নানা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। প্রসবের সময় যত এগিয়ে আসছে, দুশ্চিন্তা যেন ততই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে। কভিডের সংক্রমণ ঝুঁকি, মহামারিতে হাসপাতালগুলোতে চাপ, ঠিকমতো সেবা পাবে কি না, নিজের কিছু গর্ভকালীন জটিলতা আছে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকেন সামায়রা। এ সবকিছু মিলিয়ে একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন সামায়রা। তিনি জানান, কভিড মহামারির কারণে নিজের ও গর্ভের শিশু নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। তবে সদর হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখছেন। তিনি তাকে অভয় দিয়ে বলেছেন, চিন্তা একদম না করতে। হাসপাতালে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও প্রসবকালীন সেবা দেয়া হয়। দুশ্চিন্তা না করে সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে মহামারিতেও সংক্রমণ এড়িয়ে সুস্থ সন্তান জš§দান সম্ভব।
ফেনী সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল হোসেইন ভূঁইয়া বলেন, আমাদের বর্তমান সরকার এই মহামারির সময়ও গর্ভবতীদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। কভিডের জন্য আমাদের স্বাভাবিক কাজের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। প্রতিদিন শতাধিক গর্ভবতী নারী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসেন। ইনডোরে ভর্তি থাকেন ৩০ থেকে ৩৫ জন। যদিও আমাদের শয্যা আছে ১৭টা। এখানে প্রতি মাসে স্বাভাবিক প্রসব হয় ৪০০ এবং অস্ত্রোপচার হয় ১০০ থেকে ১৫০ গর্ভবতী নারীর।
রাবেয়া খাতুন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই কেমন জানি সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। এই করোনাভাইরাসের সময় তিনি আগামী ১০ মাস সুস্থ থাকবেন কি না। তার অনাগত শিশুর কোনো ক্ষতি হবে কি না এই ভেবে। শরীর একটু খারাপ হলে বা জ্বর অনুভূত হলেই রাবেয়ার চিন্তা বেড়ে যায়Ñতার কভিড আক্রান্ত হলো কি না, হলে কোনো হাসপাতালে ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে কি না, নানা ধরনের ভাবনা মাথায় ভর করে তার।
রাবেয়ার বাবার বাড়ি মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায়। তিনি সেখানকার একটা হাসপাতালে তার গর্ভকালীন চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেই হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেকের মধ্যেই কভিডের সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে। গর্ভধারণের পর এমনিতেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই এ সময় কভিডে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীরা কভিডে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে এবং হাসপাতালে যেতে যেন তাদের কোনোভাবেই দেরি না হয়, সেদিকে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
গর্ভবতী অবস্থায় যদি কারও কভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের জন্য সরকারি কভিড হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, এসব সরকারি হাসপাতালে কভিডে আক্রান্ত সন্তানসম্ভবাদের অগ্রাধিকারও দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই গর্ভাবস্থায় যেকোনো ফ্লু বা অন্য কোনো সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই এ সময় যেকোনো ধরনের কাশি জ্বর হলে শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে পরবর্তী ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালসহ দেশের কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এসব হাসপাতালগুলোয় নির্দেশনা দেয়া আছে, যদি গর্ভবতী নারীদের মধ্যে কভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের অবশ্যই অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হবে।
বর্তমান কভিড পরিস্থিতিতেও দেশের সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান যেমন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গর্ভবতী মায়েদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিকটস্থ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৪টি গর্ভকালীন সেবা নেয়া যাচ্ছে। প্রসবকালীন যেকোনো জটিলতা এড়াতে নিকটস্থ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিরাপদ প্রসব সেবা নিতে পারবেন। দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এএনসি বা প্রসবপূর্ব এবং পিএনসি বা প্রসবোত্তর সেবা কর্নার আছে। যেখানে মিডওয়াইফসহ দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীরা রয়েছেন। সেখানে সব স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব ও প্রসবোত্তর সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি এএনসি-পিএনসি কার্ডে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মোবাইল নম্বর দেয়া হচ্ছে। যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ এবং মোবাইল সেবা গ্রহণ করারও পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত এ মহাপরিচালক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটি জীবন নিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে কভিড। তাই সন্তানসম্ভবা মায়েদের আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই; কারণ উপযুক্ত ডায়েট, বিশ্রাম এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে খুব সহজেই বাড়িতে নিরাময় করা যায় কভিড। আর এ ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের জন্য পরামর্শ হলো, একটু বাড়তি যতœ আর বাড়তি খাবার। আমাদের সহানুভূতি এবং বাড়তি যতœই পারে কেবল কভিডকালেও গর্ভবতী নারীদের সুরক্ষিত রাখতে।
পিআইডি নিবন্ধ