Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:47 pm

কভিডকালে নারীর কর্মসংস্থান

ইরানী বিশ্বাস: যুক্তরাষ্ট্রের এক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, কভিড মহামারিকালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে লকডাউনে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় চার কোটি মানুষ। চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ভয়াবহ এ মন্দা কাটাতে সে দেশের স্টেট ও ফেডারেল সরকার প্রতি সপ্তাহে ৬০০ ডলার দুর্যোগকালীন অতিরিক্ত অর্থ সহায়তা প্রদান করে। এতে অনুমান করা যাচ্ছে, আগামীতে বেকার ভাতার সুযোগ হারাবে ২০ লাখ মানুষ।

ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের সরকার জনগণকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার মানুষকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে ইমার্জিং টেকনোলজির ওপর প্রশিক্ষণ চলছে। বিশ্বে অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে সাড়ে ছয় লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। গত ১২ বছর আইসিটি খাতের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিসিসি এক লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৭ জন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি পরিসংখ্যান-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরুষের তুলনায় সাড়ে তিনগুণ বেশি মজুরিবিহীন নারী কাজ করেন এ দেশে। কোনো নারী সপ্তাহে গড়ে ২৪ ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করে, কিন্তু কোনো মজুরি পায় না। সে হিসেবে দিনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন কাজ করে কোনো নারী। এই একই কাজ কোনো পুরুষ সপ্তাহে করে মাত্র সাত ঘণ্টা, দিনে গড়ে এক ঘণ্টা।

নারী-স্বনির্ভরতায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে একেবারে শেষের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা আইএলও প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে মোট কর্মজীবী নারীর মধ্যে স্বনির্ভর নারী ছিল ৭৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে সেই পরিমাণ কমে এসেছে ৬৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে। ২০০৬-১০ পর্যন্ত স্ব-কর্মসংস্থানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছিল, কিন্তু ২০১০ সালে হঠাৎ এই সংখ্যা কমতে শুরু করে। হঠাৎ কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, বৈশ্বয়িক আধুনিকায়নে সারা বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে নারীশক্তিকে কাজে লাগিয়ে। অথচ বাংলাদেশে নারীর কর্মক্ষমতা স্থবির হয়ে যাচ্ছে। যে দেশের নারী যতবেশি পেশাজীবী, সে দেশ তত বেশি উন্নয়নশীল হিসেবে ধরা হয়।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে বদ্ধপরিকর। তিনি চান কর্মক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় হয়ে উঠুক। রাজনৈতিক থেকে অফিস-আদালত সব ক্ষেত্রে তিনি নারীদের জন্য কোটা বরাদ্দ নিশ্চিত করেছেন। নারীদের জন্য রাজনীতিতে অগ্রাধিকার হিসেবে সংরক্ষিত আসন করা হয়েছে। বিগত দিনের তুলনায় তা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। জাতীয় সংসদে মহিলা স্পিকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীদের হাতে মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা তৈরি করতে এসএমই লোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারীকে শিক্ষিত করে তুলতে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করেছেন ডিগ্রি পর্যন্ত, যাতে লেখাপড়া শিখে কোনো নারী অফিস-আদালতে পুরুষের পাশাপাশি চাকরি করার সুযোগ পায়।

বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল হিসেবে ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশকে শুধু কাগুজে ডিজিটাল করার কথা ভাবেনি। শুরু হয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ২১ হাজার জনকে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তার মধ্যে পুরুষ ও মহিলা প্রশিক্ষণার্থীর অনুপাত যথাক্রমে ৭২ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ।

বিকেআইআইসিটি ও ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাতটি ডিপ্লোমা/পিজিডি ও ২৬টি স্বল্পমেয়াদি কোর্সের আওতায় মোট ৩৩ হাজার ৫০ জনকে আইসিটি-বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ২৩ হাজার ৪৫০ পুরুষ ও ৯ হাজার ৬০০ নারী।

অন্যান্য পেশায় চ্যালেঞ্জ থাকার কারণে অনেক নারী সেসব পেশায় যেতে উৎসাহিত হয় না। তবে কম্পিউটারের যেকোনো কাজ নারীদের জন্য খুবই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে অফিস অ্যাপ্লিকেশন অ্যান্ড ইউনিকোড বাংলা আন্ডার ডব্লিউআইডি প্রশিক্ষণ কোর্সের আওতায় এ পর্যন্ত এক হাজার ২৮০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া উইমেন আইটি ফ্রন্টিয়ার ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউআইএফআই) প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ২০১৭ সাল থেকে চলমান রয়েছে। এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে এ পর্যন্ত এক হাজার ১১ নারী উদ্যোক্তাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নারীদের উন্নয়নে ওমেন ইনোভেশন ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১০টি নারীবান্ধব প্রকল্পকে ফান্ড প্রদান করা হয়েছে। এই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে যদি কেউ মনে করেন তিনি চাকরি করবেন না, তাহলে তিনি নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রয়েছে সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণের সুবিধা।

এছাড়া বিসিসি জাতিসংঘের এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক ট্রেনিং সেন্টার ফর ইনফরশেন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ফর ডেভেলপমেন্টের (ইউএন-এপিসিআইসিটি) সহযোগিতায় ডব্লিউআইএফআই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ৫৩৬ নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, যাতে ঝামেলা ছাড়াই ব্যবসা করা যায়। অনেকেরই ইচ্ছা থাকে ব্যবসা করা, কিন্তু সংসার, স্বামী ও সন্তান ফেলে বাইরে গিয়ে ব্যবসা বা চাকরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদের অনায়াসে ঘরে বসে এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবসা করতে কোনো সমস্যা হবে না।

আইসিটি অধিদপ্তরের অধীন ‘প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ নারীকে ফ্রিল্যান্সার টু এন্ট্রাপ্রেনিয়র, আইপি টু এন্ট্রাপ্রেনিয়র, আইটি সার্ভিস প্রোভাইডার ও উইমেন কল সেন্টার এজেন্ট এ তিন ক্যাটেগরিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ দিয়েই তারা থেমে নেই। সফল প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী অনেক প্রশিক্ষণার্থী বিভিন্ন জায়গায় চাকির করছেন। এমনকি অনেক প্রশিক্ষণার্থী এখন উদ্যোক্তা হিসেবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এরই মধ্যে ৫০১ জন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং ৯১৯ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

শহর বা উপশহরগুলোই শুধু এই প্রশিক্ষণের আওতায় নেই, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ছিটমহলগুলোয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আইসিটিতে দক্ষ করে তুলতে এক হাজার ২০০ তরুণ/তরুণীকে বেসিক আইসিটি লিটারেসি ও আইটি সাপোর্ট টেকনিশিয়ান-বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তারা এখন শহর বা উপশহরে গিয়ে চাকরি করছে। কেউ কেউ নিজস্ব এলাকায় নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।

করোনা মানুষকে অত্যাধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করেছে। মানুষ এখন সশরীরে উপস্থিত না হয়েও নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করছে। বাসা থেকে অফিসের যাবতীয় কাজ করছে। দেশে-বিদেশে সফরে না গিয়েও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হচ্ছে। সেখানে আবার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেয়া হচ্ছে। এভাবেই দূর হয়েছে নিকটতম যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম। এই গুরুত্বপূর্ণ ভার্চুয়াল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ২৯৩টি সরকারি দপ্তরে ওয়াই-ফাই জোন তৈরি করা হয়েছে। ৮৮৩টি ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৬৪টি জেলা ও ৪৮৭টি উপজেলায় তাৎক্ষণিকভাবে ভিডিও কনফারেন্স আয়োজন করা সম্ভব, যার সুফল হিসেবে বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রধানমন্ত্রী সারা দেশের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উদ্বোধন করেছেন। সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছেন। এমনকি ঘরে বসে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোগীকে সরাসরি না দেখে স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে ভার্চুয়ালি চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা পাচ্ছেন কৃষি ক্ষেত্রে ই-সেবা ও ই-কমার্স সেবা। এছাড়া ট্রেনের টিকিট ও বিমানের টিকিট নিমিষেই ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব।

ডিজিটাল ফরেন্সিক ল্যাব, সাইবার রেঞ্জ, সাইবার ডিফেন্স প্রশিক্ষণ সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও ১৫টি নির্দিষ্ট সরকারি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় ক্রিটিক্যাল ইনফরমেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সাইবার সেন্সর প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার থেকে এরই মধ্যে ১৭ হাজার ২৯৩টি দপ্তরকে মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। কৃষি তথ্য ও সেবা প্রদানের জন্য বিসিসির ইনফো-সরকার-২ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৫৪টি অ্যাগ্রিকালচার ইনফরমেশন সেন্টার (এআইসি) স্থাপন করা হয়েছে। রোগীদের যাতায়াতের কষ্ট লাঘব ও ভোগান্তি হ্রাসে বিসিসি ইনফো-সরকার-২ প্রকল্পের আওতায় ২৫টি টেলিমিডিসিন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

ইনোভেশন ডিজাইন ও এন্ট্রাপ্রেনিয়রশিপ একাডেমি প্রকল্পের কো-ওয়ার্কিং স্পেসে ৪৪টি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের ১১৮ স্টার্টআপ প্রতিনিধিকে কো-ওয়ার্কিং অফিস স্পেস বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এর সবগুলোয় নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। বর্তমান সরকারের ‘ভিশন ২০২০’-এ নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য সরকার নিরলসভাবে প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। শুধু সরকার থেকেই নয়, চেষ্টা প্রয়োজন সব পরিবারের। যদি কোনো পরিবারে একজন নারী থাকে, তবে অন্য সব সদস্যের উচিত তাকে লেখাপড়া শিখে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে উৎসাহ জোগানো। অনেক পরিবার কন্যাসন্তানকে ভালো লেখাপড়া শেখায় শুধু ভালো পাত্রের দ্বারস্থ করতে। এমন ভুল যেন কোনো পরিবার না করে। সমাজ গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায়। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীর কাজে যেমন উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন, তেমনি নারীর কর্মক্ষেত্র সুস্ঠ ও সুন্দর করে তোলার দায়িত্বও আমাদের সবার। কর্মক্ষেত্রে নারীর আগ্রহ বাড়লে তবেই তো সমাজ-দেশ তথা বিশ্ব এগিয়ে যাবে।

পিআইডি নিবন্ধ