কভিডসৃষ্ট সেশনজট নিরসনে উদ্যোগ জরুরি

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন হলেও বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থোপার্জনের দ্বার উম্মোচন। মধ্যবিত্ত কিংবা নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য শিক্ষা এক বিশেষ আলোকবর্তিকা; যার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিটি সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি দারিদ্র্যতার ঘোর অমানিশা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন বুনে। সন্তান সর্বোচ্চ বিদ্যায়তনিক পাঠ চুকিয়ে কর্মস্থলে প্রবেশ করবে, পরিবারের হাল ধরবে এমনটাই হয়ে থাকে আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্ত কিংবা নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রত্যাশা। কিন্তু করোনাসৃষ্ট সেশনজট যেন তীর্থের কাক হয়ে থাকা স্বজনদের অপেক্ষার প্রহরকে আরও দীর্ঘায়িত করে তুলেছে।

মানুষের জীবনে সময়ের মূল্য অপরিসীম। হারানো সময়ের কোনো বিনিময় মূল্য হয় না। অথচ করোনা মহামারির শুরুর দিকে অনেক সময় ক্ষেপণ করে পরবর্তীতে অনলাইন পাঠদান কর্মসূচি অনেকাংশে বাস্তবায়ন করা হলেও কভিডকালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির সময়োপযোগী প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কতটা সফল হয়েছে, লাগামহীন সেশনজট স্পষ্টত তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এছাড়া প্রযুক্তিগত সর্বজনীনতায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ফলে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার দরুন দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই যথাযথ সময়ে অর্ধবার্ষিক বা বার্ষিক পরীক্ষাগুলো গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কভিডসৃষ্ট সেশনজট বিদ্যমান। দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে সেই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। টিউশন-নির্ভর শিক্ষার্থীদের করোনাকালে টিউশন হারিয়ে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরিবার-পরিজনের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে না পারায় বিপর্যস্ত ক্যারিয়ার নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে জন্ম নিচ্ছে চরম হতাশা। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কেউবা পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে পড়াশোনায় ইতি টানতে বাধ্য হচ্ছে।

সেশনজট নিরসনের প্রসঙ্গ উঠলে নীতিনির্ধারকরা জানান, তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন তবে শিক্ষার্থীদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেই উপরমহলের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ্য যে, শিক্ষার্থীরা অনেক আগেই মারা গেছে। বরং হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার পথে পা বাড়ানো শিক্ষার্থীরা অজস হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সেই আত্মিক মৃত্যুরই জানান দিচ্ছে।

সম্প্রতি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর জরিপে উঠে এসেছে, ২০২১ সালে আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১২ জন মেডিকেল কলেজের, ৪ জন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এবং ২৩ জন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই আত্মহননকারীর তালিকায় নিত্যনতুন সংযোজন অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত যেকোনো মহামারিতে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা বাড়তে পারে। কিন্তু এই প্রবণতা রুখে দাঁড়ানো আবশ্যক। আমাদের সহপাঠী ভাই, বোনদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এখন কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবুও এই বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্তই সেশনজটে আটকে থাকা শিক্ষার্থীদের বিপদাপন্ন ভবিষ্যৎ আর মৃতপ্রায় স্বপ্নগুলোকে প্রাণোচ্ছল করে তুলতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব অত্যাবশ্যক। এছাড়া হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মানসিক সমর্থন দেওয়ার লক্ষ্যে অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষকদের আরও বেশি আন্তরিক হওয়া জরুরি। আত্মহত্যা নামক এ ভয়ংকর ব্যাধি যেন নতুন কোনো মহামারিতে রূপ না নেয়, সে জন্য সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলর ও থেরাপিস্টদের যথাযথ ভূমিকা একান্ত কাম্য। সেশনজট সমস্যার সমাধান হোক। আর একটি স্বপ্নেরও যেন অপমৃত্যু না হয়।

রেহেনুমা সেহেলী কবির

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০