মোহম্মদ শাহিন: সামনে শীত, সেইসঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণের প্রকোপ। শীত ও বায়ুদূষণে অধিকতর সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউনসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব দেশে দ্বিতীয় দফায় প্রথম ধাপের চেয়ে সংক্রমণ বেশি হচ্ছে।
আসন্ন শীতে দেশে কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেক আগে থেকেই আভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও শীতের সঙ্গে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তার বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য এখনও স্পষ্ট নয়, তবে দেশে শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেখা দিতে শুরু করেছে। দুই মাস ধরে করোনা সংক্রমণের হার নি¤œমুখী থাকলেও হঠাৎ করেই গত সপ্তাহে ফের সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকে শঙ্কিত হয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা বলছেন। যদিও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তা বলার মতো পরিস্থিত হয়নি। তবে এ অবস্থা আর কিছুদিন বিরাজমান থাকলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
করোনা আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তু হলো ফুসফুস। আর শীতকাল এলেই আমাদের দেশের মানুষের ফুসফুসজনিত সমস্যা প্রকট হয়। যেমনÑহাঁপানি, ব্রংকাইটিস, ফ্লু, নিউমোনিয়া ইত্যাদির প্রকোপে আমরা দিশাহারা হয়ে যাই। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কোনো ভাইরাস শীত ও শুষ্ক আবহাওয়ায় অধিকতর বিস্তার লাভে সক্ষম। আর শীত মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক ও ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেশি থাকে। ফলে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়ানোর শঙ্কা থাকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বারবার মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু তবুও টনক নড়ছে না জনসাধারণের। গ্রামাঞ্চল এমনকি শহর ও উপশহরগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই বললেই চলে। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে চলাফেরা, হাসপাতাল ও এক শহর থেকে অন্য শহরে অবাধ যাতায়াত ছাড়াও হাটবাজার, মসজিদ, মন্দিরÑসব জায়গাতই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও উপশহর পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে দলবেঁধে ক্যারাম, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় এবং টং দোকানের চা-সিগারেটের আড্ডায় জনগণের অবাধ বিচরণ চলতে থাকলে আসন্ন শীতে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। সরকার এ পর্যন্ত করোনার সময়ে যে কাজগুলো করে অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছে, এটা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রকট হলে রপ্তানি বাণিজ্যে অভিঘাতের শঙ্কা রয়েছেÑবাড়বে দারিদ্র্য, সংকুচিত হবে কর্মসংস্থান। এর ফলে অর্থনীতি ও জনজীবন ফের বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
শীত যখন পুরোপুরি শুরু হবে, তখন কভিড মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ হতে পারে স্বাস্থ্যসেবা এবং মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। সরকার এরই মধ্যে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি গ্রহণ করেছে। এ প্রত্যয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে তা যথানিয়মে পালিত হচ্ছে কি না, তা তদারকি করতে হবে। অভিযোগ আসছে মাস্ক ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় সেবা মিলছে। সুতরাং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল ও অফিস-আদালতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কড়া নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি দেশে বায়ুদূষণের প্রকোপ বাড়ছে। আর এ বায়ুদূষণ কভিড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বায়ুদূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে একসময় পৃথিবী করোনামুক্ত হবে; কিন্তু সব মানুষ কবে নাগাদ পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর ভ্যাকসিন পেলেই তা দেশের সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাবে বা সহজলভ্য হবে কি না, তাও অজানা। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো করার বিকল্প নেই। গণমাধ্যমগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সচেতনতা বৃদ্ধিতে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রসাশন দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারে। শহর ও উপশহর পর্যায়ে জনসমাগম এড়াতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে পাবলিক স্পেস, শপিং মল ও হাটবাজারে প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল এবং মাইকিং ফলপ্রসূ হতে পারে।
গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কেননা গ্রামাঞ্চলের মানুষজন বেশ ধর্মপ্রাণ। আর গ্রামে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধর্মীয় গুরুদের দিকনির্দেশনা প্রদান ভালো ফল নিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে নামাজ বা পূজার পর ইমাম বা পুরোহিত কর্তৃক মাস্ক পরিধান, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, জ্বর হলে করোনা টেস্ট করানো, হাঁচি বা কাশি হলে হাত মুখে চেপে কিংবা কনুই ব্যবহার করে ঠেকানো প্রভৃতি বিষয় ওপরমহল থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাগুলোকে ওয়াকিবহাল করতে হবে।
প্রতিদিন প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরছেন। এক্ষেত্রে তাদের কোয়ারেন্টাইন করার ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া শীতকালে আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক কড়া নজর রাখতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নিজের সচেতনতার পাশাপাশি পরিবারের শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সুদৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, সরকারের একার পক্ষে এটি সামাল দেওয়া সম্ভবপর নয়Ñদরকার সমন্বিত পদক্ষেপ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়