Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 3:31 am

কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধ ভাবনা

নাজমুন্নাহার নিপা: নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ সংক্রমণের প্রায় এক বছর হতে চলেছে, কিন্তু থেমে নেই আক্রান্ত হওয়া রোগীর হার। বরং বিশ্বব্যাপী কভিডের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিষেধক তৈরি করার জন্য। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই আবার সংক্রমণের হার ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে কভিডের দ্বিতীয় ধাপ বলছে। তাদের ভাষ্যমতে, এটি আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করতে পারে। সংস্থাটি দেশগুলোকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়ার অনুরোধ করেছে।

বিশ্বে প্রতিদিন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ কভিডে সংক্রমিত হচ্ছে। গতকাল ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বে কভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি ৫৬ লাখ ২১ হাজার ৬২৭। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন চার কোটি ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬১ জন। মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৯৮। কিন্তু এটি কেবলই সংখ্যা মাত্র, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা ঠেকাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বিধিনিষেধের প্রতিবাদে ইতালির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বেলজিয়ামে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ভাইরাসে আক্রান্ত চিকিৎসকদেরও সেবা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লাগামহীনভাবে কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে উন্নত দেশগুলো।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফার আঘাত আরও ভয়ানক হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এর প্রভাব এরই মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও দিল্লিতে এখন কভিড সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। পাকিস্তানেও কভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।

কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশেও আবার কভিড সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেজন্য দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমিত হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

শীত শুরু হওয়ার আগে থেকেই মূলত ধারণা করা হচ্ছিল যে শীতে বাড়তে পারে কভিডের সংক্রমণ। শীত পুরোপুরি শুরু না হলেও অনুভূত হওয়ার মধ্যেই কভিড-আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি হিসেবে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, বেসরকারি হিসেবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্যবিদরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদে দেখা যায়, আগের তুলনায় লক্ষণসহ কভিড রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ভয়াবহ বায়ুদূষণ কভিড সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে যারা অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হƒদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকতে হয়। বর্তমানে রাজধানীসহ বায়ুর এই মান গড়ে ১৫০ থেকে ২০০। শীত পুরোপুরি শুরু হলে এই হার যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এর সঙ্গে কভিডের সংক্রমণ যুক্ত হলে সেটি যে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে বিপজ্জনক ধুলা ও বস্তুকণা পিএম ২.৫ যদি মাত্র এক মাইক্রোগ্রাম বৃদ্ধি পায় তাহলে সেটি কভিড-১৯-এ মৃৃত্যুর হার আট শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কভিডের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।

একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে প্রতিদিন ২৮২ টন কভিড বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এই কভিড বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, ফেস শিল্ড প্রভৃতি। এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা হচ্ছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বাজারসহ এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এ বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায় না। অথচ ব্যবহƒত এসব বর্জ্যও কভিড সংক্রমণের অন্যতম কারণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এসব বর্জ্য সাধারণ গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মিশিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে।

কভিডের বর্জ্য যে সাধারণ কোনো বর্জ্য নয়, এ বিষয়টি সরকারের প্রতিটি সংস্থাকেই বিশেষভাবে আমলে নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, এ বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে আলাদাভাবে শোধন করতে হবে। সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই। ফলে যত্রতত্র ব্যবহƒত মাস্কসহ কভিডের অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কভিড প্রতিরোধে কভিড বর্জ্য যে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে, তা বলার অবকাশ রাখে না।

এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, শীত বা অতি ঠাণ্ডায় কভিড বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিস্তার লাভ করে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো শীতপ্রধান হওয়ায় সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া এবং তৃতীয় ঢেউ শুরুর আশঙ্কার পেছনে এই শীতই কারণ হয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং শীতের সময় কখনও কখনও তীব্র শীত অনুভূত হয়। এখনও শীত পুরোপুরি শুরু হয়নি, তার আগেই কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আলামত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শীত যদি তীব্র হয়ে ওঠে কিংবা স্বাভাবিক শীতের মাত্রায় থাকে, তখন পরিস্থিতির যে অবনতি হতে পারে, তা এখনই আশঙ্কা করা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যেসব নিয়মকানুন জনসাধারণকে অবহিত করা হয়েছে, তাদের তা স্মরণ করিয়ে দিতে নতুন করে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়াসহ জনসমাগম এড়িয়ে চলার বিষয়গুলো নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন এবং টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে অনতিবিলম্বে ব্যাপক প্রচার করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণত শীত মৌসুমে বিয়েসহ অন্যান্য জনসমাগমমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।

রাজধানীর ধুলা নিয়ন্ত্রণে খোঁড়াখুঁড়ি করে ফেলে রাখা সড়ক মেরামতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। কভিড থেকে রক্ষা পেতে জনসাধারণকেও সচেতন ও সতর্ক হয়ে চলতে হবে। আবার আমরা অনেকেই ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পেতে ইলেকট্রিক রুম হিটার ব্যবহার করি। এই  রুম হিটার ব্যবহার করার ফলে নাক এবং শ্বাসনালির প্রতিরোধকারী পর্দা (মিউকসা) শুষ্ক হয়ে যায়। তখন ভাইরাস সহজেই দ্রুত পর্দা ভেদ করতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে এই পর্দা দ্রুত নাক ও শ্বাসনালিতে অনুপ্রবেশকারী যাবতীয় রোগজীবাণু, বালুকণা ও ময়লা পরিষ্কার করে। কিন্তু তাপমাত্রা কমে গেলে এটির পরিষ্কার করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

শীতকালে ভাইরাসযুক্ত ছোট বায়ুকণা অধিক সময় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ফলে অধিক মানুষ সংক্রমিত হয়। শীতকালে সাধারণত অন্যান্য ঠাণ্ডাজনিত অসুখ হয়ে থাকে, যেমনÑফ্লু, শ্বাসনালি-ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, নানা ধরনের শিশু রোগ প্রভৃতি। যখন অন্য একটি ভাইরাস সংক্রমিত করে তখন ভাইরাসের সংক্রমণ সহজ হয়ে যায়। কারণ প্রথম ভাইরাসটি রোগীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি দখল করে রাখে।

যুক্তরাজ্যে ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা তাদের এক গবেষণায় দেখেছেন, সাম্প্রতিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা আট দশমিক পাঁচ শতাংশ ধ্বংস করে দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এ জীবাণু মানুষের মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকতে পারে অন্তত ১০ বছর। এই গবেষকরা ৮৪ হাজারের বেশি কভিড-আক্রান্ত ও সুস্থ হওয়া মানুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, কভিড থেকে কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর মুক্তি পেলেও এর প্রভাব রয়ে যাচ্ছে অধিকাংশের শরীরে।

এছাড়া শরীর ব্যথা, ক্লান্তি, হƒদরোগসহ আরও উপসর্গ থাকছে। মস্তিষ্কের এ পরিস্থিতির তারা নামকরণ করেছেন ‘ব্রেন ফগ’ হিসেবে। গবেষকরা আরও জানান,  কভিড-১৯ থেকে যারা সেরে উঠছেন তাদের ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ) নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ শরীরের মধ্যে এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা টেকে মাত্র কয়েক মাস। এর পরই ওই ব্যক্তি আবার কভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তাই সবাইকে সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমানে আমাদের দেশের হাটবাজার কিংবা গণপরিবহন সব জায়গায় একই অবস্থা দেখা যায়। মানুষের মধ্যে মাস্ক না পরার একটা তীব্র অনীহা রয়েছে। অথচ কভিড প্রতিরোধে সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিরাপদ দূরত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোনো কিছু স্পর্শ করার পরে হাত স্যানিটাইজ করা এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ওপর পরামর্শ রয়েছে। এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে আমাদের স্বার্থেই, যাতে আমরা সুস্থ থাকতে পারি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শীতের সময়ে কভিডের সংক্রমণ ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি রাখতে হবে। মাস্ক ব্যবহার না করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবাইকে নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। শীতে বিভিন্ন দূষণ থেকে দূরে থাকতে হবে, কেননা দূষণের কবলে পড়লে অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে, যার ফলে কভিডের প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় টেস্ট বাড়িয়ে এবং রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসার জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। কভিড ভ্যাকসিন যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের হাতের নাগালে না আসছে, তত দিন নিজ থেকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।

শিক্ষার্থী

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ