নিজস্ব প্রতিবেদক: ভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে দেশের শিক্ষা খাতে বড় ধরনের ক্ষতিসাধিত হয়। প্রায় দেড় বছর বিদ্যালয়ে সশরীরে পাঠদান বন্ধ ছিল। এরপর যখন সশরীরে পাঠদান শুরু হয়, তখন দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে ফিরে আসেনি। এ ঝরে পড়ার হার মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বেশি।
২০২১ সালে পরিচালিত এক জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কার্যালয়ে গতকাল ‘সার্ভে অন চিলড্রেন এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জরিপটি পরিচালনায় সহায়তা করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
জরিপে কভিড সংক্রমণ-পূর্ব সময় ও সংক্রমণকালীন স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। এই স্তরে কভিডের আগে ২০১৯ সালে স্কুলের বাইরে ছিল ছয় দশমিক চার শতাংশ ছেলে-মেয়ে। আর ২০২১ সালে কভিডকালে এ হার বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক চার শতাংশ। এদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। কভিডের আগে প্রাথমিক স্তরে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল আট দশমিক এক শতাংশ। কভিডকালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ দশমিক এক শতাংশ। অন্যদিকে এ স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ২০১৯ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল সাড়ে চার শতাংশ। আর ২০২১ সালে কভিডকালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ছয় শতাংশ। অর্থাৎ, মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ছেলেদের স্কুলের বাইরে অবস্থানের হার অনেক বেশি।
এ চিত্র নিন্ম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও পরিলক্ষিত হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নি¤œ মাধ্যমিক স্তরে মোট ঝরে পড়ার হার ২০১৯ সালে ছিল ১৩ দশমিক এক শতাংশ। ২০২১ সালে কভিডকালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ছয় শতাংশে। এ স্তরে ২০১৯ সালে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল
১৮ দশমিক এক শতাংশ। কভিড সময়ে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ছয় শতাংশ। অন্যদিকে এ স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ২০১৯ সালে ছিল আট দশমিক এক শতাংশ। আর ২০২১ সালে কভিড সময়ে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২ শতাংশে। এছাড়া জরিপে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্তরকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ স্তরে মোট ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ২০১৯ সালে ছিল ৩১ দশমিক পাঁচ শতাংশ, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক দুই শতাংশে। এর মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার করোনার আগে ছিল ৩৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আর করোনার মধ্যে এ হার দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক আট শতাংশ। আর মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ স্তরে ঝরে পড়ার হার করোনার আগে ছিল ২৬ দশমিক এক শতাংশ। আর করোনার মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ছয় শতাংশ।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সব স্তরের মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ছেলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ছেলে শিক্ষার্থীদের ওপর করোনার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ স্তরে করোনার আগে যে হারে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে থাকত, করোনাকালে সে হার প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি পায়।
বিবিএস বলছে, করোনা মহামারির আগে একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে পড়াশোনা করত ৬ ঘণ্টা। করোনার সময় স্কুল বন্ধ থাকায় একজন শিক্ষার্থীর এ পড়ার হার গড়ে ৪ ঘণ্টা কমেছে। অর্থাৎ স্কুল বন্ধ থাকায় একজন শিক্ষার্থী গড়ে ২ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে। তাদের জরিপ বলছে, কোভিডকালে প্রাথমিক বিদ্যালগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ছিল ৮০.৫ শতাংশ। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে তা ছিল ৫৯.৬ শতাংশ আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ছিল ৫০.৫ শতাংশ। যা ২০১৯ এর তুলনায় প্রাথমিকে কিছুটা কমলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছুটা বেড়েছে।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বিবিএসের ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের পরিচালক মো. মাসুদ আলম বলেন, আন্তর্জাতিক মানের জরিপ পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্র অনুসরণ করে সারাদেশে মোট ৯ হাজার খানায় আমরা জরিপটি করেছি। মাঠে আমরা যা তথ্য পেয়েছি তাই প্রকাশ করেছি।
অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে কভিডের প্রভাব বিষয়ে আগে নির্ভরযোগ্য কোনো সরকারি পরিসংখ্যান ছিল না। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে বিবিএস সে শূন্যতার জায়গাটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছে। এ জরিপের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এখন শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্ট ঘাটতি পূরণে পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়ক হবে। ভবিষ্যতে সরকারের প্রয়োজনে এ ধরনের জরিপ পরিচালনায় বিবিএস অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিবিএস মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, বিবিএস সবসময় জাতির প্রয়োজনীতার কথা বিবেচনায় রেখে সময়ানুগ ও নির্ভরযোগ্য সরকারি পরিসংখ্যান প্রস্তুতে কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের জরিপ কার্যক্রম বিবিএসের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। নিয়মিত বিভিন্ন শুমারির পাশাপাশি এ ধরনের চাহিদাভিত্তিক জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিবিএস সবসময় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আগ্রহী।
অনুষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, করনোয় শিক্ষায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিবিএসের জরিপ তা আবার প্রমাণ করেছে। আমরা আমাদের ঘাটতির জায়গাগুলো দেখিছি। তিনি আরও বলেন, ‘ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব সহনশীল মাত্রায় ছিল। তিনি এ ধরনের জরিপ পরিচালনার জন্য বিবিএস ও ইউনিসেফকে ধন্যবাদ জানান।