Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 7:01 pm

কভিড চিকিৎসায় আলো দেখাচ্ছে প্লাজমা থেরাপি

মো. জিল্লুর রহমান: বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়তই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হওয়ায় কভিড-১৯ রোগীদের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা এখন ভরসা করছেন কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির (সিপিটি) ওপর।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, যা একটি শ্বাসযন্ত্রের রোগ। জ্বর দিয়ে শুরু হয় এবং পরে শুকনো কাশি হয়। এক সপ্তাহ পর এটি শ্বাসকষ্টের দিকে নিয়ে যায় এবং কিছু রোগীর হাসপাতালের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

বিশ্ব জুড়েই মহামারি করোনার টিকা ও ওষুধ বের করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনার চিকিৎসা করার প্রয়াসও চলছে। চিকিৎসকরা সে রকমই একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনার চিকিৎসায় প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন। ডাক্তারি ভাষায়, এই পদ্ধতির নাম হলো প্লাজমা থেরাপি। প্লাজমা হলো রক্তের জলীয় উপাদান। বাংলায় বলা হয় ‘রক্তরস’। সহজে বলা যায়, যাদের করোনা হয়েছিল এবং সেরে উঠেছেন, তাদের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বা রক্তে প্রোটিনজাতীয় পদার্থ তৈরি হয়, যা ওই ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে।  প্লাজমা পদ্ধতির অর্থ হলো, ওই ব্যক্তিদের রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে করোনা-আক্রান্ত রোগীর শরীরে দেওয়া, যাতে রোগীর শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

প্লাজমা হলো রক্তের তরল অংশ, যা যখন সমস্ত লাল ও সাদা রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেটগুলো সরিয়ে ফেলার পর থাকে। সিপিটিতে সুস্থ হওয়া রোগীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা বর্তমানে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ব্যবহার করা হয়। আসলে প্লাজমাতে থাকে নানা দরকারি প্রোটিন, রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর আর থাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন, যাকে আমরা অ্যান্টিবডি বলি।

আর এই প্লাজমা একই ভাইরাসে আক্রান্ত অন্য একজনের শরীরে শিরাপথে প্রবেশ করিয়ে যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাকেই বলা হয় ‘কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’। যেহেতু এই প্লাজমাতে ভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি আছে এবং তা সেরে ওঠা একজন রোগীর শরীর থেকে সংগ্রহ করে অন্য একজন আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়, সে কারণে একে ‘প্যাসিভ অ্যান্টিবডি থেরাপি’ও বলা যায়।

এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিন, ফ্যাপিরাভির, রেমডিসিভির, প্লাজমা থেরাপি প্রভৃতি দিয়ে করোনার চিকিৎসায় ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত করোনার চিকিৎসায় চূড়ান্তভাবে কোনো ওষুধের নাম অনুমোদন করেনি, তার পরও করোনার চিকিৎসায় কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি আশাব্যঞ্জক ফলাফল দিচ্ছে।

তবে মনে রাখা দরকার, কভিড-১৯ চিকিৎসায় এখনও সবকিছুই মূলত পরীক্ষামূলক বা ট্রায়াল। পূর্ববর্তী ট্রায়ালগুলো থেকে এখন পর্যন্ত খুব আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কভিড-১৯-সংক্রান্ত তাদের চিকিৎসা নীতিমালা থেকে প্লাজমা থেরাপি তুলে নিয়েছে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার চলতে পারে বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অবস্থানও তাই। ২৫ এপ্রিল কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিপিটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ৪ এপ্রিল সিপিটি অনুমোদন করেছে। যেহেতু এটি পরীক্ষামূলক, তাই এতে রোগী বা রোগীর বৈধ অভিভাবকের লিখিত সম্মতির প্রয়োজন হয়। এটি যে পরীক্ষামূলক এবং আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় না, এই বিষয়টিও পরিষ্কার করতে হবে।

কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কিন্তু একেবারেই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দে এ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন হয়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম ডিপথেরিয়া রোগের চিকিৎসা দিয়েই এ পদ্ধতির গোড়াপত্তন হয়। শুরুর দিকে কোনো পশুকে আক্রান্ত করে সেটির শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা হতো। পরে জটিলতার কারণে মানবশরীরের প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়।

জার্মান ফিজিওলজিস্ট এমিল ফন বেহরিং প্রথমে থেরাপি হিসেবে প্লাজমা ব্যবহার করার ধারণাটি চালু করেন। তিনি ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে প্লাজমা সিরাম থেরাপির ব্যবহার করে ১৯০১ সালে ফিজিওলজিতে প্রথম নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।

পরবর্তীকালে ১৯২০ সালে এই প্লাজমা স্কারলেট ফিভার চিকিৎসায়ও ব্যবহƒত হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত হুপিং কাশি রোগের চিকিৎসা এ প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমেই দেওয়া হয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময় এই কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহƒত হয়। এরপর হাম, মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও জলবসন্তের চিকিৎসায়ও প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়, যদিও ফলাফল ছিল মিশ্র প্রকৃতির।

সিপিটি এখন পর্যন্ত কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরোনো চিকিৎসা, যা নিকট অতীতে ২০০৩ সালে সার্স, ২০০৯ সালে বার্ড ফ্লু, ২০১২ সালে মার্স করোনাভাইরাস এবং অতি সম্প্রতি ২০১৩ সালে ইবোলা ভাইরাস-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহƒত হতে দেখা গেছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন সম্ভাব্য প্লাজমা ডোনার বা প্লাজমাদাতা। আগে কভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন আর এখন পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন এবং নেগেটিভ হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিন) কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি, এমন ব্যক্তিই হতে পারেন প্লাজমাদাতা। প্লাজমা দানের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তার শরীরে যথেষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয়েছে কি না। এ জন্য অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ১: ১৬০ টাইটার হলে প্লাজমা থেরাপির জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্যান্য শর্ত, যেমন রক্তবাহিত রোগের (সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, এইচআইভি প্রভৃতি) উপস্থিতি, প্লাজমাদাতার ওজন, রক্তচাপ, গর্ভাবস্থা প্রভৃতি বিষয়গুলো দেখতে হয়।

একজন দাতার শরীর থেকে একবারে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। অ্যাফেরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে পুরো রক্ত না নিয়ে শুধু প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। একজন দাতার প্লাজমা দিয়ে তিন ইউনিট পর্যন্ত (প্রতি ইউনিট ২০০ মিলিলিটার) প্লাজমা বানানো যায়। দাতা চাইলে একবার প্লাজমা দেওয়ার পরের সপ্তাহে আবারও প্লাজমা দিতে পারেন। প্লাজমা দান করার পর ২৪ ঘণ্টায় তিন লিটার পানি পান করলেই এর অভাব পূরণ হয়ে যায়। তাই দাতার এক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশে এপ্রিলের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অধীনে প্লাজমা চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় উপকমিটি গঠন করা হয় এবং ২৮ এপ্রিল করোনা-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সিপিটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ডিজিএইচএস’কে সারা দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও তদারকি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারতসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ চিকিৎসার অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এ থেরাপি সফল হয়েছে এবং আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে এটি সফল হয়েছে। তবে এটি সফলভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য একটি সুষ্ঠু প্লাজমা নীতিমালা তৈরি ও অনুমোদন খুবই দরকার।

অবশ্য প্লাজমা থেরাপিতে তেমন কোনো ঝুঁকি এখনও পাওয়া যায়নি। তবে রক্ত বা রক্ত উপাদান পরিসঞ্চালনের যেসব ঝুঁকি আছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। যেমন অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, রক্তবাহিত জীবাণু সংক্রমণ, পরিসঞ্চালনজনিত ফুসফুসের সমস্যা প্রভৃতি। যাদের এ ধরনের সমস্যা আছে, তাদের প্লাজমা না দেওয়াই ভালো।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, এক্ষেত্রে দাতার প্লাজমা দানে এগিয়ে আসতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। দাতাদের কাছ থেকে যত বেশি প্লাজমা পাওয়া যাবে, ততই সিপিটি ব্যবহার করে কভিড-১৯ মোকাবিলা করা সহজ হবে এবং কভিড-১৯ চিকিৎসায় আশার আলো ততই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক

rbbbp@gmail.com