নজরুল ইসলাম: কভিড মহামারি শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপী টিকা দেয়াকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে শুরুতে ভালো অবস্থানে থাকলেও পরে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ। গত বছর জুলাইশেষে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে অবস্থান করছিল বাংলাদেশ। সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ দ্রুত কভিড টিকাদান এগিয়ে নিলেও বাংলাদেশে গতি ছিল না। তবে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ হয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ ও জনগণকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে এক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে কভিড টিকাদানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ভুটান। বিশ্বব্যাংকের গত ২ জুন প্রকাশিত পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে কভিডে বাংলাদেশে এ বছরের শুরু থেকে মৃত্যুর সংখ্যাও কমে এসেছে। টানা ৩০ দিন মৃত্যুহীন ছিল দেশ।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ১১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষকে টিকাদানের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। তবে এরই মধ্যে ১১ কোটি ৭৬ লাখ মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ তার লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান ও মালদ্বীপ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জনগোষ্ঠীকে টিকা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম অবস্থানে থাকা ভুটান ছয় লাখ ৭০ হাজার মানুষকে টিকা দিয়েছে, যা দেশটির জনগণের ৮৬ দশমিক দুই শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মালদ্বীপ তিন লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দিয়েছে, যা জনগোষ্ঠীর ৭০ দশমিক ছয় শতাংশ। আর শ্রীলঙ্কায় এক কোটি ৪৫ লাখ মানুষ টিকার আওতায় এসেছে, যা দেশটির জনগোষ্ঠীর ৬৭ দশমিক চার শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে ৮৯ কোটি মানুষ টিকার আওতায় এসেছে, যা দেশটির জনগোষ্ঠীর ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ। নেপালে এক কোটি ৯৩ লাখ মানুষ টিকার আওতায় এসেছে, যা দেশটির জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ। আর পাকিস্তানে ১২ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ টিকার আওতায় এসেছে, যা দেশটির জনগোষ্ঠীর ৫৪ দশমিক সাত শতাংশ। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান মাত্র ৪৮ লাখ অর্থাৎ ১২ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম সেরা কভিড ভ্যাকসিনগুলোর প্রায় সবগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে। মূলত চারটি প্রক্রিয়ায় কভিড ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। আরএনএ ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন, লাইভ এটিনিউয়েটেভ ভ্যাকসিন এবং ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন। বাংলাদেশে এর সবগুলো, যেমন আরএনএ ভ্যাকসিন (ফাইজার ও মডার্না), ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন (অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন), লাইভ এটিনিউয়েটেড (সিনোফার্মা) প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত ২ জুন পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১২ কোটি ৮৭ লাখ ৮৬ হাজার ২৩৪ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬১৪ জন। আর বুস্টার ডোজ নিয়েছেন এক কোটি ৫৫ লাখ ৬১ হাজার ৩৩৩ জন।
এদিকে আজ থেকে ১০ জুন সারাদেশে করোনা টিকার বুস্টার ডোজ সপ্তাহ উদ্?যাপনের ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঘোষিত এই কর্মসূচির আওতায় ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব সবাই করোনার টিকার বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার চার মাস পর বুস্টার ডোজ নেয়া যাবে। ৪ থেকে ১০ জুন এই সাত দিনের যেকোনো দিন নিকটবর্তী টিকাকেন্দ্রে গিয়ে করোনার টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নেয়া যাবে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে করোনার বুস্টার ডোজের টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুস্টার ডোজের পাশাপাশি করোনার টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান থাকবে। করোনা প্রতিরোধে টিকা একটি কার্যকর সমাধান। করোনার টিকার পূর্ণ সুফল পেতে হলে অবশ্যই তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নিতে হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বহুদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ। এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যেসব দেশ বিনা মূল্যে টিকা পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ টিকার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশে মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৮ ভাগ করোনার টিকা দেয়া হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি বলেই দেশে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ঈদ উদ্?যাপন করতে পেরেছি। দেশের অর্থনীতি চালু আছে। ছয় শতাংশ জিডিপি আছে। যেসব দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে নেই, সে দেশের অর্থনীতি মন্দার দিকে। পৃথিবীতে যেসব দেশের অর্থনীতি চাঙা আছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।’
এদিকে গত ৩১ মে ইউনিসেফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এক বছরে (২০২১ সালের ১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে) ইউনিসেফ বাংলাদেশে কোভ্যাক্সের আওতায় ১৯ কোটির বেশি ডোজ কভিড-১৯ টিকা সরবরাহ করেছে। এখন পর্যন্ত কোভ্যাক্সের আওতায় সবচেয়ে বেশি টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি এক ডোজ টিকা দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে শুরু হয় কভিড টিকা দেয়ার কর্মসূচি। প্রথম দিনে পরীক্ষামূলকভাবে মোট ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। এরপর ৭ ফেব্রæয়ারি সর্বসাধারণের জন্য টিকা দেয়া শুরু হয়।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যু হয় ১৭ মার্চ। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। আর ২০২১ সালের ৫ আগস্ট ও ১০ আগস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর আসে, যা মহামারির মধ্যে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা। তবে গত ২০ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত মাসে টানা ৩০ দিন বাংলাদেশের কভিডে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি।