Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:20 pm

কভিড টিকার বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতি

মো. জিল্লুর রহমান: কভিড টিকার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যে বৈষম্য চলছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি লোক এখনও এক ডোজ টিকাও পায়নি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পৃথিবীতে যত কভিড টিকা উৎপাদিত হয়েছে, তার ৭৫ শতাংশই গেছে মাত্র ১০টি দেশে। অন্যদিকে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট হিসাব করে বলেছে, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অর্ধেকই গেছে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশের কাছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোয় টিকা দেয়া হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। নিম্ন আয়ের দেশগুলো এক শতাংশের অর্ধেকের কম টিকা পেয়েছে এবং আফ্রিকায় মাত্র পাঁচ শতাংশের কম লোকের টিকার পুরো ডোজ সম্পন্ন হয়েছে।

করোনাভাইরাস একদিকে মানুষের প্রাণ হরণ করছে, অন্যদিকে টিকা নিয়ে বিশ্বরাজনীতিও বেশ জমে উঠেছে। এখন প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হচ্ছে টিকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে টিকার আবিষ্কার, উৎপাদন ও বিপণন নিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর কৌশল ও ভূ-রাজনীতি। এ নিয়ে চলছে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। মোটাদাগে পাঁচটি দেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ভারত এখন করোনার টিকার রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে খুবই সক্রিয়। এ দেশগুলো কভিডের টিকাকে তাদের কূটনীতির হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

করোনাভাইরাসের টিকা বাজারে আসার অনেক আগে থেকেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকে ভারত থেকে টিকা সংগ্রহের আশা করেছিল। দেশগুলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা সরবরাহের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপরই নির্ভর করেছিল। এর কারণ হচ্ছে, এসব দেশে সুলভে সরবরাহের শর্তে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছিল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতেও টিকা সরবরাহের কথা ছিল ভারতের। বাংলাদেশ তখন দারুণ আগ্রহ নিয়ে আগাম অর্থ দিয়ে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কেনার চুক্তি করে বেশ কিছু টিকাও নিয়ে আসে। ভারত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার টিকার বাজারের একচেটিয়াকরণ করতে চেয়েছিল। তারা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশকেই বিপুল পরিমাণ টিকা উপহার দেয়। এমনকি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, এমন কিছু দেশকেও তারা উপহার হিসেবে বিপুল পরিমাণ টিকা পাঠায়। কিন্তু দেশটিতে ভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্র কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণেই হিমশিম খাচ্ছে। ফলে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অধিকসংখ্যক মানুষকে দ্রুত টিকা দিতে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি দেশটি তখন বাধ্য হয়ে অন্যান্য বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আমদানি শুরু করে।

কভিড-১৯ মহামারি এখন বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সুবিধাকেই সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে চাইছে চীন ও রাশিয়া। কেবল পররাষ্ট্র নীতিমালা নিয়ে আপসের মাধ্যমে নয়, বরং টিকার বদলে তারা নিজেদের অনুকূলে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনেও মনোযোগ দিয়েছে। ভারতের মতো চীন ও রাশিয়াও একইভাবে টিকাকে রাজনীতি ও কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। রুশ সরকার এখন পর্যন্ত ৭০টির বেশি দেশে টিকা পাঠাতে সম্মত হয়েছে। চীনও দ্রুত সময়ের মধ্যে ১০০টি দেশে টিকা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। যদিও শুরুর দিকে দেশ দুটির টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ছিল খুবই কম। পশ্চিমা গণমাধ্যমও দেশ দুটির টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নানা প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল। তবে ভারতে সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশ দুটির টিকা রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। দুটি দেশই দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ ও উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে।

টিকার মেধাস্বত্ব শিথিল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস প্রযুক্তি রাশিয়া ও চীনের দখলে চলে যেতে পারে বলে এমনিতেই উদ্বেগে ছিল বাইডেন প্রশাসন। অন্যদিকে ভারত অসন্তুষ্ট হতে পারে, এ কারণেও চীনা টিকার পরীক্ষা ও সরবরাহের বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তবে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে চীনের সিনোফার্ম এবং দ্বিতীয় টিকা হিসেবে সিনোভ্যাক কোম্পানির উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।

দেখা গেছে কেবল বাংলাদেশই নয়, ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানির মতো নাক উঁচু পশ্চিমের অনেক দেশও চীন ও রাশিয়ার টিকা নেয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম প্রথম দিকে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকাকে পাত্তা না দিলেও বর্তমানে পরিস্থিতি বদলেছে। কার্যত কোনো উপায় না পেয়েই তারা পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরের টিকা নেয়ার গরিমা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে চীনও ঘোষণা করেছে, তাদের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দুটো ‘বৈশ্বিক জনসাধারণের সম্পদ’।

অন্যদিকে পেটেন্টের কারণে চাইলেই টিকার উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এ নিয়েও আছে রাজনীতি ও কূটনীতি। ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকার সূত্র কিনে রেখেছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বাইরে কেউ টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়া ও চীন নিজেদের অনুকূলে থাকা পররাষ্ট্রনীতির বিনিময়ে বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ ও উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেছে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের অনেক দেশই এখন টিকা বানাতে প্রস্তুত, কিন্তু অপেক্ষা শুধু টেকনোলজি ট্রান্সফারের। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রও টিকার পেটেন্টে সাময়িকভাবে ছাড় দিতে সম্মত হয়েছে। তবে পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বে ছাড় দেয়ার প্রসঙ্গ ওঠার পর থেকে এর বিরোধিতাও জোরালো হয়ে উঠেছে। ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ধনী দেশগুলোর করোনার টিকা ব্যবহারের কৌশলকে ‘অনৈতিক ও মূর্খতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। গুতেরেস বলেন, দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়ায় মহামারির বিরুদ্ধে দেশগুলোর নিজস্ব সুরক্ষা কমার ঝুঁকিতে রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান দুজনই উপস্থিত ছিলেন। টিকার বৈষম্য করোনা মহামারি দীর্ঘায়িত করার প্ররোচনা দিচ্ছে। তিনি বলেন, এর কারণে নতুন নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে, যেগুলো ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চেয়েছিল, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যেন প্রতিটি দেশের অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ টিকার পূর্ণ ডোজ পায়। কিন্তু বিশ্বের ৫৬টি দেশে এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

গত জুন মাসে জি-সেভেন গোষ্ঠীর সাতটি দেশ কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল, আগামী এক বছরে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দান করা হবে। যুক্তরাজ্য অঙ্গীকার করেছিল তারা দেবে ১০ কোটি টিকা, কিন্তু তারা ৯০ লাখেরও কম টিকা সরবরাহ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, তিনি ৫৮ কোটি টিকা দান করবেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে মাত্র ১৪ কোটি। আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২৫ কোটি টিকা দেয়ার কথা বললেও সরবরাহ করেছে তার মাত্র আট শতাংশ।

ইরানের মতো অনেক মধ্য আয়ের দেশ কোভ্যাক্স থেকে টিকা কিনেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থিত একটি উদ্যোগ। কোভ্যাক্স মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে কম দামে টিকা বিক্রি করবে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে বিনা মূল্যে দান হিসেবে দেবে, এটাই ছিল পরিকল্পনা। ২০২১ সালে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা ছিল ২০০ কোটি টিকা সরবরাহ করা, যা আসার কথা ভারত থেকে। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক চেহারা নেয়ার পর ভারত সরকার টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়।

টিকা সরবরাহে এই গুরুতর বিঘেœর পর কোভ্যাক্স মূলত ধনী দেশগুলোর দানের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু সরবরাহের গতি অত্যন্ত ধীর। কোভ্যাক্সের টিকা পাওয়া কিছু দেশ এখনও তাদের জনসংখ্যার দুই শতাংশকেও টিকা দিতে পারেনি। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকেই অনেকগুলো দেশে টিকা সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু খোদ ভারতেই রোগী বেড়ে যাওয়ায় টিকা সংকট দেখা দিয়েছে।

হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বেশিরভাগ টিকা কিনে নেয়ায় অনেক দেশের জন্য করোনা টিকার প্রথম ডোজই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে কারণে সংকট আরও বাড়ছে দেখে ধনী দেশগুলোকে সেপ্টেম্বর মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত ‘বুস্টার ডোজ’ কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলেছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নাগরিকদের অতিরিক্ত এক ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করার কারণেই এ আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু ধনী দেশগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ অব্যাহত রেখেছে।

এয়ারফিনিটি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, টিকা সারাবিশ্বের সরবরাহ সমস্যা নয়, বরং ধনী দেশগুলো তাদের হাতে অতিরিক্ত টিকা মজুত করে রাখছে। টিকা উৎপাদনকারীরা এখন প্রতিমাসে ১৫০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ এক হাজার ১০০ কোটি টিকা উৎপাদিত হবে। এর ফলে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর হাতে ১২০ কোটি ডোজ টিকা থাকবে। বুস্টার টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আসলে ওই টিকাগুলো তাদের দরকার হবে না। এমনকি ওই টিকাগুলোর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এখন ফেলে দেয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যদি সেগুলো অতি শিগগিরই অন্য দেশগুলোকে দান না করা হয়। তাহলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, টিকার রাজনীতি ও কূটনীতির জালে পড়ে কোটি কোটি মানুষ টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক

zrbbbp@gmail.com