নাসরীন মুস্তাফা: কভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই টিকা কবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে জোর আলাপ-আলোচনা চলেছে। উন্নত দেশগুলোও মৃত্যুর হার কমাতে পারছিল না। বয়স্ক মানুষদের মৃত্যুহার বেশি এবং শিশুরা অনেকটা বিপদমুক্ত ভেবে এসব আলোচনায় শিশুদের বিষয়টি আসেনি। তাই বলে শিশুদের জীবন বাঁচাতে এতকাল টিকা দেয়ার যে কাজ চলছিল, তাতে মনোযোগ কমে যাবে, তা কী করে হয়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো ভয় ধরানো তথ্য দিয়ে বলছে, সত্যিই নাকি বিশ্বের অনেক দেশ শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম ঠিকভাবে চালাচ্ছে না। এর ফলে হাম, ডিপথেরিয়া ও যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। এর ফলে বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দিনকে দিন বাড়ছে।
মহামারির ফলে মৃত্যু সংবাদ পাওয়া এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো শিশুদের বিপদের সংবাদ আসুক, তা মোটেও চাই না। ২০২০ সালে হামের টিকার প্রথম ডোজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ৯০ লাখেরও বেশি শিশু। আরও ৮৫ লাখ শিশু ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টংকার আর হুপিং কাশির টিকার তৃতীয় ডোজ পায়নি। দ্য ল্যানসেট নামে ১৮৯৩ সাল থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকার ১৪ জুলাই সংখ্যাতে এই হিসাব মিলেছে। সব দেশের টিকাদানের তথ্য হয়তো গবেষকদের কাছে সম্পূর্ণভাবে যায়নি, এই খুঁত যুক্তি হিসেবে টেনে আনলেও মনের ভেতর ভয় বাসা বাঁধছে। তথ্য ও হিসাব সবসময় কি সঠিকভাবে পাওয়া যায়? ভয়ের আশঙ্কা কোথাও কোথাও অতটা না হলেও কোথাও হয়তো আরও অনেক ব্যাপক। কভিড মহামারি এরই মধ্যে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কোনো দেশকে বিপদে রেখে অন্য দেশ ভালো থাকতে পারবে না। একজন মানুষকেও হিসাবের বাইরে রাখার সুযোগ আসলে নেই।
২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিল বটে। ২০১৯ সালের তুলনায় হামের টিকা কম পেয়েছে কমপক্ষে ৩৫ লাখ শিশু। আরও ৩০ লাখ শিশু হামের টিকার প্রথম ডোজ পায়নি। ২০২১ সালের ১৪ জুলাই শিশুদের ডিপথেরিয়া-ধনুষ্টংকার আর হুপিং কাশির ডিটিপি টিকাদান কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়া ১১ দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যাতে প্রথমেই আছে ভারতের নাম। এরপর পাকিস্তান। এরপর পর্যায়ক্রমে আছে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, তানজানিয়া, আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা ও মালির নাম।
এদিকে ২০২১ সালে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া কভিড মহামারির তৃতীয় ঢেউ শিশুদের জন্যও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে খবর আসছে। ভাবতেও ভয় পাচ্ছি, আগে থেকে সংক্রামক রোগগুলোর সঙ্গে কভিডজনিত সমস্যা যোগ হলে শিশুদের জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে পরিস্থিতি!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ডিটিপি টিকাদানের হার শতকরা ষাট ভাগ কমে এসেছে। দ্য ল্যানসেটের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, এই অঞ্চলে হামের টিকা দেয়া হয়েছে আগের চেয়ে ৪০ ভাগ কম শিশুকে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের আগেও দক্ষিণ এশিয়ার ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত টিকা থেকে বাদ পড়েছে। বাদ পড়ার সংখ্যা এরপর থেকে আশঙ্কাজনকভাবে কেবলই বাড়ছে। মরবিডি অ্যান্ড মোর্টালিটি উইকলি রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের শিশুদের ক্ষেত্রেও টিকাদানের হার কমে গেছে বলে জানিয়ে ১১ জুন সংখ্যায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ডিটিপি টিকার হার ছয় শতাংশ ও হামের টিকার হার আট শতাংশ কমে গেছে।
বিশ্বব্যাপী শিশুদের স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে গেছে, একথা বলাই যায়। কভিড মোকাবিলায় লকডাউন চলছে বলে টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া মুশকিল হয়েছে। টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি করেছে। ইউনিসেফ ২০১৯ সালে ২২৯ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারলেও ২০২০ সালে পেরেছে ২০১ কোটি ডোজ। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও বিমান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় কোনো কোনো দেশে টিকার মজুত কমে গেছে বিপজ্জনক মাত্রায়। লকডাউনে টিকা কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। টিকা কেন্দ্র খোলা রাখলেও বাবা-মায়েরা ভয়ে শিশুদের নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে যেতে চান না। পরিবারের উপার্জন কমে গেছে, বয়স্ক সদস্য বা উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে স্বাভাবিক সময়ের সব কাজ। ফলে শিশুর টিকা দেয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে পারেনি পরিবারগুলো। এরকম কত বিষয়ই তো আছে!
স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাবা-মায়েরা শিশুকে টিকা কেন্দ্রে নিয়ে গেলে স্বাস্থ্যকর্মীরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে টিকাকেন্দ্রে টিকা দেয়ার কাজটি করলে কোনো সমস্যা তো নেই। ভয় নয়, সচেতনতা বজায় রেখে শিশুর টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেই হবে। এই বিষয়টি অনুধাবন করেছে বাংলাদেশ। টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরামর্শগুলো মেনে কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে শিশুদের নিয়মিত টিকা দিতে নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে মহামারির শুরুতে হোঁচট খেলেও ২০২০ সালের জুন থেকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে পেরেছে শিশুদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি এই টিকাদান কার্যক্রম। মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে মাসিক টিকাদানের হার বেড়ে কভিড-১৯-এর আগের সময়ের হারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছে ইউনিসেফ। বাংলাদেশ ইউনিসেফের উপ-প্রতিনিধি ভিরা মেন্ডোনিকা একে বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে দেখছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে কিছু চমৎকার ছবি ছাপা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে টিকাকেন্দ্রে আসা মায়েরা শিশুকে কোলে নিয়ে অপেক্ষমাণ। রংপুরের বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকায় চলছে টিকাদান কার্যক্রম।