মো. আবদুর রহমান : বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত করোনাভাইরাসজনিত প্রাণঘাতী রোগ কভিড। সভ্যতার ইতিহাসে খুব কম উদাহরণ রয়েছে, যেখানে একটা রোগ এত দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, মুখে মাস্ক পরলে সার্স ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। মুখে মাস্ক থাকলে আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন সংক্রমণ ছড়াতে পারে না, তেমনি মাস্ক পরলে সুস্থ ব্যক্তিও সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। তাই সার্স ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার করা একান্ত অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বলেছে, সার্স ভাইরাস বায়ুবাহিত। সিডিসি জানিয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে দুই মিটারেরও বেশি দূরে থাকা কোনো ব্যক্তি বায়ুবাহিত ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষত আক্রান্ত ব্যক্তি যখন হাঁচি-কাশি দেয়, কিংবা কথা বলে, তখন তার কাছ থেকে যে সূক্ষ্ম ড্রপলেট বা অ্যারোসল বাতাসে উড়ে আসে, তার মাধ্যমেও হতে পারে সংক্রমণ। নাক, মুখ, এমনকি চোখের মাধ্যমেও তা দেহে প্রবেশ করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি মাস্ক পরে থাকলে এ ধরনের ড্রপলেট (তরল বিন্দু) তেমন ছড়াতে পারে না, কারণ মাস্ক তা আটকে দেয়। একইভাবে সুস্থ মানুষ মাস্ক পরে থাকলে এই ড্রপলেটের মাধ্যমে নিজে সংক্রমিতও হয় না। সুস্থ মানুষের পক্ষে তখন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে মাস্ক। আর সামাজিক দূরত্ব মেনে চললেও সার্স ভাইরাসের এই ধরনের ড্রপলেট থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
জর্জ ওয়াশিংটন স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমোলজিস্ট ডেভিড মাইকেলস বলেন, হাঁচি বা কাশির পর ড্রপলেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ বা অ্যারোসল কণার মাধ্যমে তিন-চার ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে সার্স ভাইরাস। এটি এমনকি কয়েক মিটার পর্যন্তও ভেসে যেতে পারে। যেসব ঘরে আলো-বাতাস কম থাকে সেখানে বা বিভিন্ন যানবাহনের আবদ্ধ জায়গায় এটি বেশি মারাত্মক হতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ডভিস চিলড্রেনস হাসপাতালের গবেষক অধ্যাপক ড. উইলিয়াম রিসটেন পার্ট বলেন, জানালা-দরজা খোলা নেই, এমন বদ্ধ ঘরে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থেকে বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে সার্স ভাইরাস। এ কারণে বদ্ধ পরিবেশ এড়িয়ে চলা উচিত। তবে অনেক ক্ষেত্রেই মুখে মাস্ক পরা থাকলে এ ধরনের পরিবেশেও ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ, যা বিশ্ববাসীকে মেনে চলতে হবে, সেগুলো হলো মাস্ক পরা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা এবং নিয়মিত হাত ধোয়া, নয়তো যথার্থ স্যানিটাইজার ব্যবহার করা।’ চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ‘মাস্ক পরা, চোখকে সুরক্ষা দেয়া ও সঠিকভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে সার্স সংক্রমণ হওয়ার হার অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে।’ কোনো কারণে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব হয়তো সবসময় মানা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে বাঁচার একমাত্র উপায় মাস্ক পরে নাক ও মুখ ঢেকে রাখা। এতে সুস্থ ব্যক্তি সার্স সংক্রমিত ব্যক্তির কাছাকাছি গেলেও মাস্কই তাকে বাঁচায়।
বস্তুত মাস্ক পরার অর্থ সার্স ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচানো এবং অন্যের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ানো। মাস্ক করোনা সংক্রমণ থেকে ৯০ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। আক্রান্ত ও সুস্থ ব্যক্তি, যদি দুজনই মাস্ক পরিধানরত থাকেন, তাহলে সংক্রমণের হার থাকে মাত্র এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। চীনের বেশ কটি গবেষণায় দেখা যায়, মাস্ক পরিধানের কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ লোক সার্সে আক্রান্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছে। মাস্ক পরিহিত অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস মাস্কের ভেতরের বাতাসের আর্দ্রতা বাড়ায়। এতে সার্স ভাইরাসের ক্ষতিসাধনের সক্ষমতা কমে যায়। ফলে কভিডে আক্রান্ত হলেও এর তীব্রতা কমে যায়। গবেষকরা দেখেছেন, মাস্কের কারণে কম ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে ঢুকতে পারে। এর ফলে সার্সের তীব্রতা কম হয়। অবশ্য অনেক গবেষক এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অনেক সময় শ্বাসতন্ত্রের ভেতরের অংশ শুষ্ক হয়ে যায়। এ সময় মাস্কের ভেতরের আর্দ্র বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাসকে আর্দ্র করে। এই আর্দ্রতা শ্বাসনালিকেও আর্দ্র করে। এই প্রক্রিয়া ভাইরাস রোধে সহায়ক। কাপড়ের মাস্ক এক্ষেত্রে ভালো ফল দেয়। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক করোনা সংক্রমণ ইনডেক্স জ-কে ১-এর নিচে কমাতে সক্ষম, যার অর্থ হলো কভিড সংক্রমণ স্থায়ীভাবে নি¤œমুখী হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মনিকা বলেন, মাস্ক শুধু সংক্রমণই কমায় না, এটি কভিডের তীব্রতা ও মৃত্যুহারও কমায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কটি অঙ্গরাজ্যে মাস্কের ওপর পরীক্ষায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
ঘর থেকে বাইরে বের হলে অবশ্যই নাগরিকদের মাস্ক পরতে হবে। আবার ঘরে অতিথি এলেও মাস্ক পরতে হবে। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে বের হলে মাস্ক পরার দরকার নেই। তবে সঙ্গে রাখতে হবে; কেউ কথা বলতে এলে মাস্ক পরে নিতে হবে। অফিসে আলাদা ঘর থাকলে সব সময় মাস্ক পরার দরকার নেই। তবে কেউ ঢুকলে পরতে হবে। মাস্ক পরে ব্যায়াম করা উচিত নয়। এতে শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। যেসব শিশুর হাঁপানি বা জন্মগত হার্টের অসুখ আছে, তাদের মাস্ক পরানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এন-৯৫ মাস্ক পরে গাড়ি না চালানোই ভালো। এতে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেলেও চালাতে অসুবিধা হতে পারে। কাজেই ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালালে মাস্ক পরার দরকার নেই। অবশ্য এখন বলা হচ্ছে, সার্স ভাইরাস বায়ুবাহিত, তাই বাইক বা সাইকেল চালালেও মাস্ক পরতে হবে। বিজ্ঞানীদের মতে, মাস্ক একটি না পরে বরং একসঙ্গে দুটি পরা উচিত। দুটি মাস্ক ব্যবহারের কারণে যত ক্ষুদ্র জীবাণু বা ভাইরাসই হোক না কেন, তা নাক বা মুখ দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। আর নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ি বা ওড়নাকে মাস্ক মনে করা অযৌক্তিক। কারণ এগুলো কোনোভাবেই ভাইরাস রোধে সুরক্ষা দেয় না।
মাস্ক ব্যবহারের আগে ও পরে কিছু নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মাস্ক পরার আগে প্রথমে সাবান বা অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে দু’হাত পরিষ্কার করে নিতে হয়। হাত পরিষ্কার করে মাস্কটি এমনভাবে পরতে হবে, যাতে নাক ও মুখ পুরোপুরি ঢাকা থাকে এবং ত্বকের সঙ্গে একেবারে লেগে থাকে। কোনো কারণেই মাস্ক ও ত্বকের মাঝে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। অনেকেই মাস্ক পরে তা নাক বা থুতনির নিচে ঝুলিয়ে রাখেন। এটা করা একেবারেই উচিত নয়। এছাড়া গরম, ঘাম প্রভৃতি কারণে মাস্ক পরতে সমস্যা হয়Ñএসব কারণে কখনোই মাস্ক খোলা যাবে না। ঘেমে গেলে মাস্ক পরিবর্তন করতে হবে। বাইরে থেকে ফেরার পরই মাস্ক খুলতে হবে। মাঝখানে কখনোই খোলা বা নামিয়ে রাখা যাবে না। বাড়ি ফিরে মাস্ক খোলার সময় হাত ধুয়ে বা স্যানিটাইজ করে দুই দিকের দুটি ফিতা ধরে মাস্ক খুলতে হবে। এরপর তা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আবার হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে।
তাছাড়া বারবার মাস্কে হাত দেয়া একবারেই ঠিক নয়। মাস্কের সামনের অংশ স্পর্শ করা ক্ষতিকর। নিতান্তই যদি মাস্কের সামনে হাত দেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাস্ক স্পর্শ করার পরে আবার হাত পরিষ্কার করতে হবে। নোংরা ও ভেজা মাস্ক যাতে কোনোভাবেই ব্যবহার করতে না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেইসঙ্গে অন্যের ব্যবহƒত মাস্কে হাত দেয়া উচিত নয়। ভারতীয় চিকিৎসক পি. শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘অনেকেই দু-তিন সপ্তাহের বেশি সময় না ধুয়ে একই মাস্ক ব্যবহার করে যান, যেখান থেকে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।’ এ সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত মাস্ক পরিবর্তন কিংবা ব্যবহƒত মাস্ক সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। মাস্ক খুলে একে অপরের সঙ্গে কথা বললে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই মাস্ক না পরে সবাইকে সরাসরি কথা না বলার পরামর্শ দেন গবেষকরা। সেক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করার পদ্ধতি হতে পারে সবচেয়ে বেশি সহায়ক।
পিআইডি নিবন্ধ