কভিড ভ্যাকসিন যেন অস্ত্রে পরিণত না হয়

ফারহান ইশরাক: সময় ছুটে চলা নদীর মতোই বহমান। পৃথিবীর যাবতীয় পরিবর্তন হয় সময়ের ব্যবধানেই। সময়ের এই অবিরাম বয়ে চলায় পুরোনো ধ্যানধারণা, গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও বিশ্বাস বদলে যায়। একইভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ও অস্ত্র এই শব্দগুলোরও প্রচলিত সংজ্ঞা বদলে যায়। মহামারির এই সংকটও যেন অনেক কিছুর সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে।

গত বছরের শেষে চীনে উৎপত্তি লাভ করা করোনাভাইরাস পৃথিবীর চিত্র পাল্টে দিয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবনযাপন পদ্ধতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। করোনার ফলে মানুষের চিন্তাভাবনা এবং জীবনের প্রায়োগিক দিকগুলোতেও বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষণীয়। পৃথিবীর এই সামগ্রিক পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠিতে পরিণত হয়েছে এই মারণব্যাধি ভাইরাস।

করোনার তাণ্ডব থেকে বাঁচতে সারা পৃথিবীর মানুষের অপেক্ষা এখন একটি ভ্যাকসিনের জন্য। অধরা সেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সারা বিশ্বের অসংখ্য বিজ্ঞানী। তাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টার ফলে পৃথিবীবাসীর মনে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। কিছু দেশ সফলভাবে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ঘোষণাও দিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের হাতে ভ্যাকসিন আসার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন ও গবেষণা যেমন একদিকে আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি এর অন্ধকার অংশটিও সমানভাবে সত্য। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও স্নায়ুযুদ্ধ নতুন কিছু নয়। করোনার সময়েও এই প্রতিযোগিতা লক্ষ করা গেছে। এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রাণান্ত চেষ্টা। কোন দেশ তার প্রতিপক্ষ দেশের তুলনায় কত দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারে, তা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা প্রশংসার দাবিদার এবং এর ফলে ভ্যাকসিনের আবিষ্কারের পথ যে আরও দ্রুততর হয়েছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এর মধ্যে শঙ্কাও লুকিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য গ্রুপে বিভক্ত হয় পৃথিবী। ফলে দুই পরাশক্তির মাঝে স্নায়ুযুদ্ধও প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। তাই অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও বিতরণকে কেন্দ্র করে বর্তমান পরাশক্তিগুলোর মধ্যে আবারও স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয় কি না। যদি তা-ই হয়, তবে বিশ্বের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য সেটি হবে ভয়াবহ ও অমঙ্গলকর।

ভ্যাকসিন নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো কোনো ফল নিয়ে আসবে না, বরং এ থেকে বেশ কিছু বড় ধরনের সমস্যা উদ্ভূত হতে পারে। যেমন পারস্পরিক মতপার্থক্য বা বিরোধের কারণে এক দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সমর্থ হলেও তার প্রতিপক্ষ দেশকে ভ্যাকসিন প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। এতে সেই দেশের মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার চড়া মূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করলে তা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরেই রয়ে যাবে, যার ফলে এর কোনো সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদিকে কেবল প্রতিযোগিতার খাতিরে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলে তা যদি কার্যকর না হয়, সেটিও সাধারণ মানুষকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। উপরন্তু ভ্যাকসিন পাওয়া ও না-পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি হবে, যার পরিণাম হবে পৃথিবীব্যাপী ভয়াবহ সংঘাত।

ভ্যাকসিন মানবজাতির কল্যাণের জন্যই প্রস্তুত করা হয়। তাই এর সঠিক ব্যবহার যদি নিশ্চিত করা যায়, পৃথিবীর মানুষই তাতে উপকৃত হবে। ভ্যাকসিন যেন কখনও অপশক্তিতে পরিণত না হয়, সেদিকে নজর রাখা জরুরি। অতি দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার হোক, এটি সবারই প্রত্যাশা। শক্তিধর দেশগুলোর সুস্থ প্রতিযোগিতায় কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে তা মহামারি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এই ভ্যাকসিন যেন অস্ত্র হিসেবে কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহƒত না হয়। সম্প্রতি রাশিয়ার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের নাম দেয়া হয়েছে ‘স্পুটনিক-৫’। এই নামকরণ সোভিয়েত যুগের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কেউ কেউ ভাবছেন এ ধরনের নামকরণ থেকে স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাতও হতে পারে। তাই ভ্যাকসিন যেন অস্ত্রের নতুন সংস্করণ না হয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহƒত হয়, সেজন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ব মিডিয়াকেও সরব ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে কোনো দেশ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে। কোনো একটি দেশ সফলভাবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ না করলে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের ব্যবহার ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষ তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন হাতে পাবে। আর এর জন্য দরকার পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে সহাবস্থান। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০