নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগ (কভিড-১৯) সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ হয়েছে, যদিও বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে আট দশমিক দুই শতাংশ, যা কভিড মহামারির বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্জন করা কঠিন হবে।
কভিড একটি অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট, যা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা ও বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতাকে প্রভাবিত করেছে। কভিড-১৯-এর প্রকৃতির কারণেই কোনো জাতীয় সীমানার মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো কভিডের কারণে উদ্ভূত স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। জি-২০, ডব্লিউএইচও, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মহামারিকে কাটিয়ে উঠতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) এ সংস্থাগুলোর অনেকের সঙ্গেই ব্যবসা-সংক্রান্ত পরামর্শদাতা হিসাবে সহযোগিতা করছে।
আইসিসি ২৬ মার্চ ভার্চুয়াল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তিতে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পদক্ষেপ এবং মানব-অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি রোধের পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। এ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় মেডিকেল সরঞ্জামের সরবরাহের প্রবাহ ঠিক রাখা এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় আকারের আর্থিক স্টিমুলাসের জন্য জি-২০-এর যে প্রতিশ্রুতি, তা অন্যতম। কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং ভবিষ্যৎ পুনর্নির্মাণের জন্য জি-২০ দেশগুলোর জন্য রোডম্যাপসহ আইসিসি জি-২০ বাণিজ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী দেশগুলো মহামারির কারণে তাদের অর্থনীতিকে সহায়তা করার জন্য জরুরি করব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতি উদ্দীপনা বাস্তবায়ন করছে।
মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার ফলে পুরো অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে যায়। লকডাউনের ফলে জীবিকা-নির্বাহের জন্য প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহামারিজনিত প্রভাবের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১৬ দশমিক চার মিলিয়ন মানুষ নতুনভাবে দরিদ্র হবে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২৬ মার্চ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি দুই দশমিক দুই শতাংশ কমে যেতে পারে। ফলে জি-২০-এর অধিকাংশ দেশ, যেমন জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তেলের মূল্য কমে যাওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলেও প্রবৃদ্ধি কম হবে। এসব কারণে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি আয়, শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আশ্চর্যজনকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেকর্ড ১৮ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার হয়েছে, তবে পোশাক খাতের অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে রপ্তানি আয় ১৭ শতাংশ কমে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ৮৪ শতাংশ আয় পোশাক খাত থেকে অর্জিত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক। একই সময়ে এফডিআই ১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে তিন দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৭৭ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন টাকার (আনুমানিক আট বিলিয়ন ডলার) উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা চারটি কর্মসূচির মাধ্যমে অবিলম্বে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে (জনসাধারণের ব্যয় বৃদ্ধি, একটি উদ্দীপক প্যাকেজ প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা নেট কাভারেজ বাড়ানো ও আর্থিক সরবরাহ বৃদ্ধি)। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য সরাসরি নগদ সহায়তাসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যেগুলোর মধ্যে কভিড-১৯ সংক্রমণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী ও ব্যাংকারদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা, ব্যাংকার, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যদের জন্য বিশেষ সম্মাননা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান অন্যতম।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ওপর স্থগিতাদেশ এবং এ সময় ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫০ বিলিয়ন টাকার (৫৯৫ মিলিয়ন ডলার) উদ্দীপনা প্যাকেজের বিশদ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে কারখানার মালিকদের জন্য বেতন প্রদানের সহায়তা হিসাবে দুই শতাংশ সুদে দুই বছরের জন্য ঋণ সুবিধা রয়েছে।
অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির মতো বাংলাদেশকেও কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেশ কয়েকটি মূল সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, যার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই রপ্তানি, এফডিআই ও রেমিট্যান্স প্রবাহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং সরবরাহ চেইনগুলো কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী রাখতে এমএসএমইগুলো (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) সংরক্ষণ করা খুব জরুরি।
অতএব, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিভিন্ন উদ্দীপক প্যাকেজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন ও নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইসিসিবি ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়