শেখ আবু তালেব: বাংলাদেশের আমদানি দায় পরিশোধে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনবদ্য ভূমিকা রাখে। এজন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ভিত শক্ত অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরেই দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি নিন্মমুখী ধারায় রয়েছে। এর ফলে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি। পাঁচ বছর পূর্বে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সেখানে গত ডিসেম্বরে ছিল ঋণাত্মক ২০ শতাংশ।
জানুয়ারিতে কিছুটা উন্নতি হলেও প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। যদিও এরই মধ্যে আশাব্যঞ্জক হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্স। এসব দেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধিতে এখনও কোনো সমস্যা দেখছে না বাংলাদেশ। কিন্তু যেভাবে পণ্য আমদানি বাড়ছে, সে তুলনায় বাড়ছে না রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের চাপে পড়বে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় পাওয়া গেছে এমন তথ্য। মূলত বাংলাদেশের প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। একক হিসেবে মোট প্রবাসীর প্রায় ৩৫ শতাংশই সৌদি আরবমুখী। এজন্য একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরটিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮তে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয় ২১ দশমিক আট শতাংশ, ২০১৮-১৯ পুনরায় কমে গিয়ে হয় ১২ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয় ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর পরের অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে বছরটিতে।
কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ওই অর্থবছরটির অর্ধেকই ছিল করোনা সংক্রমণের উচ্চহারের সময়। এ সময় প্রবাসীদের কাছে থাকা সঞ্চিত অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। প্রায় ৪০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন একেবারেই। এছাড়া সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দুই শতাংশ হারে প্রণোদনার ঘোষণা দেয়। এতেই বেড়ে যায় রেমিট্যান্স প্রবাহ। সেই ধারা এখন ধরে রাখা যাচ্ছে না।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার প্রণোদনার হার দুই থেকে বৃদ্ধি করে আড়াই শতাংশে উন্নীত করেছে। এর ফলে গত জানুয়ারিতে কিছুটা বেড়েছে প্রবাহ। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মকই রয়ে গেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে দক্ষ শ্রমশক্তিকে দায়ী করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. রিজওয়ান রহমান। তিনি বলেছেন, অন্যান্য দেশ থেকে চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন পেশার কারিগরি খাতের টেকনিশিয়ানরা যান বিদেশে। তাদের বেতন ও সুবিধাদি বেশি। আমাদের দেশে প্রচুর চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের পাঠানো যায়। এতে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থারও উন্নতি হবে। তাদের অনেকেই দেশে এসে বন্ধু চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করবেন। অথচ আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রবাসীই যাচ্ছেন নির্মাণ, ড্রাইভার, হোটেল বয় ও গৃহকর্মীর কাজে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২০ শতাংশে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রবাস গমনের হার কমে গেছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রবাস গমনের তথ্য সংরক্ষণ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মসংস্থানের জন্য পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে বিদেশে গিয়েছেন ১০ লাখ আট হাজার জন ব্যক্তি। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গিয়েছেন পাঁচ লাখ ৫১ হাজার। পরের বছর ২০১৮ সালে গিয়েছেন সাত লাখ ৩৪ হাজার, ২০১৯ সালে সাত লাখ, ২০২০ সালে মাত্র দুই লাখ ১৭ হাজার ও সর্বশেষ ২০২১ সালে গিয়েছেন ছয় লাখ ১৭ হাজার।
জনশক্তি রপ্তানির এই তারতম্যর প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেই নয়, রেমিট্যান্সের কারণেই সচল রয়েছে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত ২ ফেব্রুয়ারি দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।
এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের রপ্তানি দায় পরিশোধ করা যাবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশের তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার সক্ষমতার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হয়।
এদিকে করোনা সংক্রমণের উচ্চহার কমে গিয়েছিল গত বছরের আগস্ট মাস থেকে। অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধিতে তখন থেকেই আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম বাড়তে থাকে। এর ফলে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্যও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে এক ডলার ক্রয়ে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের ৮৬ টাকা ১০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতেই ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও গত সপ্তাহে ডলারের বিনিময় মূল্য কিছুটা কমে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা হয়েছে।
আমদানি তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে দেশের আমদানি পণ্যের প্রবৃদ্ধি উঠেছে ৬৩ শতাংশে। সাধারণ সময়ে এই হার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের ঘরেই থাকে। গত জানুয়ারি শেষে তা হয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশে। এখন আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বর্ধিত এই আমদানি চাপ সামাল দিতেই ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনার হার দুই থেকে আড়াই শতাংশে করা হয়েছে। এতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নয়ন প্রয়োজন। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও কৌশলী উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে। কারণ আমাদের চাকরির বাজারে যে হারে নতুন তরুণ প্রবেশ করছে, বিপরীত দিকে সেভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না। এজন্য মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে প্রতি বছর অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে হাজারো তরুণ। এজন্য মাঝে মধ্যেই সংবাদ আসে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরে মারা যাচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা।
আবার প্রবাসীরা যাতে সহজইে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে, সে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসীরা যাতে কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে। এর সঙ্গে বন্ডগুলোতে প্রবাসীদের বিনিয়োগের হার বাড়ানো যেতে পারে। এভাবে বহুমুখী পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করছেন তারা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। বাংলাদেশের শ্রমবাজার বর্তমানে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বিস্তৃত। এর মধ্যে আবুধাবি, দুবাই, কাতার, জর্ডান, বাহরাইন, লিবিয়া, ওমান, কুয়েত, কোরিয়া, ইরাক, জর্দান, জাপান, মিসর, থাইল্যান্ড, স্পেন, মস্কো, গ্রিস, হংকং, মালয়েশিয়া, লেবানন, মালদ্বীপ, ব্রুনাই, মরিশাস, সিঙ্গাপুর, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া উল্লেখযোগ্য।
অদক্ষ কর্মীর পাশাপাশি এখন দক্ষ শ্রমিকও সরবরাহ করছে বাংলাদেশ। তারা মূলত মেশিন অপারেটর, রংমিস্ত্রি, কার্পেন্টার, নির্মাণ শ্রমিক, ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান, দর্জি, ওয়েল্ডার, পেইন্টার, ড্রাইভার, কৃষি শ্রমিক, রেস্তোরাঁর ওয়েটার পদে চাকরি করছেন।