কমছে মোবাইল খাতের ভ্যাট, নেই নীতিমালা

রহমত রহমান: মোবাইল খাতে ভ্যাট আদায় কমেই চলেছে। কোনো কোম্পানিকে নম্বর সিরিজ অনুমোদন না দেয়ায় কমছে ভ্যাট আদায়। কোনো কোনো কোম্পানি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে আমদানি করছে মেশিনারিজ। যাতে আমদানি পর্যায়ে পরিশোধিত ভ্যাট পরে রেয়াত নেয়ায় কমে যাচ্ছে ভ্যাট আদায়। আবার ইন্টারনেট ডেটার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণের কারণেও কমছে ভ্যাট। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার, ইমো ব্যবহারের ফলে কমে গেছে ভয়েস কল। ফলে কমে যাচ্ছে ভ্যাট আদায়। মোবাইল ফোন খাতে এভাবে ভ্যাট কমে যাওয়ায় ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। মোবাইল খাতে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা করার সুপারিশ করেছেন ভ্যাট কর্মকর্তা ও মোবাইল খাত-সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বৃহত করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) এক সভায় এ সুপারিশ করা হয়।

এনবিআর সূত্রমতে, এলটিইউর ভ্যাট আদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত মোবাইল। তিনটি বেসরকারি ও একটি সরকারি মোবাইল অপারেটর বিশাল অঙ্কের ভ্যাট জোগান দেয়। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর চারটি মোবাইল অপারেটর থেকে ৮ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬ হাজার ৪৮৭ কোটি ৫৯ লাখ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪ হাজার ৯৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৬ মাস চলে গেছে। এর মধ্যে এ খাত থেকে আশানুরূপ ভ্যাট আদায় হয়নি। এ খাতে ভ্যাট আদায়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হওয়ায় এলটিইউর ভ্যাট লক্ষ্য আদায় নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ খাতে কী কারণে ভ্যাট আদায় কমে যাচ্ছে তা নিয়ে গত মাসে এক পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে এলটিইউ। সভায় সভাপতিত্ব করেন এলটিইউর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী।

সভায় গ্রামীণফোনের প্রতিনিধিরা বলেন, গ্রামীণফোন ২০২০-২১ অর্থবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে দুই হাজার ৩৯৫ কোটি ৭ লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধ করেছে দুই হাজার ১৯৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিগত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর ছয় মাসে ২০০ কোটি ২৯ লাখ টাকা কম রাজস্ব পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ে, নির্বাচন কমিশন ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হতে বকেয়া ৮২ কোটি ৬৮ লাখ এবং নভেম্বর মাসে ডিলার কমিশনের বিপরীতে ১৬৩ কোটি টাকা উৎসে ভ্যাট আদায় হয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো বকেয়া ও উৎসে ভ্যাট আদায় না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় কমেছে। তবে বকেয়া ছাড়া নিয়মিত ভ্যাট বেশি আদায় হয়েছে ৪৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

রাজস্ব কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গ্রামীণফোনের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বিটিআরসি হতে নতুন নাম্বার সিরিজ অনুমোদন না পাওয়ায় গ্রামীণফোন নতুন সিম বিক্রি করতে পারেনি। ফলে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে ভ্যাট পরিশোধ কমে গেছে। কারণ সিম বিক্রি থেকে ভালো ভ্যাট আসে। এছাড়া গ্রামীণফোন তাদের নেটওয়ার্কের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। নতুন টাওয়ার বসানো হচ্ছে, আরও বেশি স্পেকটার্ম কেনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সেবার মান বাড়বে।

বাংলালিংক প্রতিনিধিরা বলেন, বাংলালিংক ২০২০-২১ অর্থবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৪৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে, যেখানে চলতি অর্থবছর ছয় মাসে পরিশোধ করেছে ৭৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছর ৬ মাসে ৩২ কোটি ৭১ লাখ টাকা বেশি ভ্যাট পরিশোধ করেছে। তবে অর্থবছরের শেষ সময়ে ভ্যাট পরিশোধ কমে আসবে। কারণ বাংলালিংক ফাইভ-জি সম্প্রসারণ করার জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করছে। যাতে রেয়াত নেয়াত হলে ভ্যাট পরিশোধ কমে যাবে।

রবি আজিয়াটার প্রতিনিধিরা জানান, রবি গত অর্থবছর জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধ করেছে এক হাজার ১৯৯ কোটি ১ লাখ টাকার ভ্যাট। যা চলতি অর্থবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পরিশোধ করেছে এক হাজার ১৬৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৩ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। করোনার কারণে জুলাই-আগস্ট মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকার উৎসে কর্তন কম হয়েছে। রবিও ফাইভ-জি সম্প্রসারণের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করছে, যাতে পরিশোধ ভ্যাট রেয়াত নেয়া হলে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ কমে আসবে। বিটিআরসি ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে না দেয়ায় অপারেটরগুলো ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করছে। এর ফলেও রাজস্ব কমে যাচ্ছে। আবার আইএসপিদের কারণেও ইন্টারনেট থেকে ভ্যাট আদায় কমে যাচ্ছে। সেজন্য অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে আইএসপিদের ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার সুপারিশ করেন তারা।

টেলিটক প্রতিনিধিরা জানান, টেলিটক গত অর্থবছর জুলাই-ডিসেম্বর মাসে রাজস্ব পরিশোধ করেছে ৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যেখানে চলতি অর্থবছর জুলাই-ডিসেম্বর মাসে পরিশোধ করেছে ৭৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৬ কোটি ৬ লাখ টাকা বেশি পরিশোধ করেছে। তবে অর্থবছর শেষে এই অপারেটর থেকে রাজস্ব আদায় আরও বাড়বে।

বিটিআরসি প্রতিনিধিরা জানান, নতুন সিম নিয়ে গ্রামীণফোন প্রতিনিধিরা যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়। অপারেটরগুলো টানা ১৫ মাস অব্যবহƒত থাকা সিম রিসাইক্লিং সিম হিসেবে বিটিআরসির অনুমোদন নিয়ে বিক্রি করতে পারে। গ্রামীণফোন দুই দফায় অনুমোদন নিয়ে এসব সিম বিক্রি করেছে। গ্রামীণফোনের গ্রাহক কাভারেজ ৪৬ শতাংশের বিপরীতে বার্ষিক মুনাফা যেখানে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেখানে অন্যান্য অপারেটরদের (রবির গ্রাহক কাভারেজ ২৯.৬৮ শতাংশ ও বাংলালিংক ২০.৫৮ শতাংশ) ক্ষেত্রে বার্ষিক মুনাফা মাত্র একশত থেকে দেড়শ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে মনোপলি ব্যবসা এড়ানোর জন্য সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট প্লেয়ার (এসএমপি) হিসেবে গ্রামীণফোনের ভূমিকা সতর্কতার সঙ্গে বিটিআরসি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সভায় বলা হয়, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তোরণ হবে। এরই আলোকে মোবাইল খাতের ভূমিকা, বিনিয়োগ কী হবে এবং এই খাতের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সভায় ছয়টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সিদ্ধান্তগুলো হলো প্রথমত, অপারেটরগুলো বিটিআরসির অনুমতি নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি করে। এরপরও এসব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশকে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। যার থেকে ভ্যাট আদায় করা হয়। ফলে মোবাইল খাতের কস্ট অব ক্যাপিটাল বেড়ে যায় এবং বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রেয়াতি সুবিধায় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির সুযোগ দিতে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়।

দ্বিতীয়, সিম ট্যাক্স কমে যাচ্ছে। ফলে সিম খাত থেকে আদায় করা ভ্যাট অন্য খাত থেকে আদায়ে নজর দিতে বলা হয়।

তৃতীয়ত, সীমান্ত এলাকায় বিটিএস বসানোর শর্ত শিথিল, চতুর্থ আইএসপিদের ভ্যাট বাড়ানো, পঞ্চমত ওটিটি প্লাটফর্ম হোয়াইটসঅ্যাপ, ভাইভার, ইমো, টিকটক থেকে ভ্যাট আদায় এবং ষষ্ঠত, মোবাইল খাতে ভ্যাট আদায়ে নীতিমালা করার সুপারিশ করা হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০