Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:08 pm

কমিউনিটি ক্লিনিক: প্রত্যন্ত অঞ্চলেরপ্রসূতিদের দোরগোড়ায় সেবা

ইলিয়াছ হোসেন পাভেল: স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও উদ্যোগ। মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া বা তাদের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যে উন্নতি সাধন করেছে, তাতে কমিউনিটি ক্লিনিকের বড় ভূমিকা রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতিদিন চার লাখের বেশি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও পুষ্টিসেবা পায়। প্রয়োজনীয় ৩০ ধরনের ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষ বিনামূল্যে পাচ্ছে। সারাদেশের গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনিকগুলো। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। গ্রামীণ প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১৩ হাজার ক্লিনিক নির্মাণের কথা ভাবা হয়েছিল। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। এর মধ্যে চালু হয়েছিল প্রায় চার হাজার। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকের কাজ বন্ধ করে দেয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওদের দিয়ে ক্লিনিক চালানোর কথা তখন ভাবা হয়েছিল। ২০০৯ সালে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর যেসব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর মেয়াদি ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভ’-এর আওতায় প্রাথমিকভাবে সারাদেশে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩৬৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়।

অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সরকারি হিসাবে বর্তমানে সারাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি ক্লিনিক চালু অবস্থায় আছে। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন মানুষ সেবা নেয়। আরও ১৪৬টি ক্লিনিক চালুর অপেক্ষায় আছে। ক্লিনিক থেকে মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং সাধারণ আঘাতে চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রতিটি ক্লিনিকে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষার পাশাপাশি দেয়া হয় পুষ্টি শিক্ষা। বয়স্ক, কিশোর-কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেয়া হয়। প্রজনন স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্ব সেবার পাশাপাশি পুষ্টি শিক্ষা ও সম্পূরক অণুপুষ্টি প্রদান, বয়স্কদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক পালনীয় বার্তা সম্পর্কে স্বাস্থ্য শিক্ষাবিষয়ক সেবাও প্রদান করা হয় এসব ক্লিনিকগুলোয়।

কমিউনিটি ক্লিনিকে জরুরি বা মারাত্মক রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয় না। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) প্রতি কর্মদিবসে এতে সেবাদান করেন। তাছাড়া স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রত্যেকে ন্যূনতম তিনদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবাদান করেন। শুক্রবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন (শনি থেকে বৃহস্পতিবার) কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা দেয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হওয়ার ফলে ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-কবিরাজি ইত্যাদি অপচিকিৎসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে অবহেলিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ছে। বাংলাদেশের এ কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যগাথা নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ রেভুল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে পুস্তিকাও ছেপেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে ৭৪ হাজার ৭১৬টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া উল্লিখিত সময়ে ৭৭ কোটির অধিক ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সেবা গ্রহণ করেছে এবং এর মধ্যে তিন দশমিক ৫৪ কোটির অধিক জরুরি ও জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক নারীদের প্রসবপূর্ব (গর্ভকালীন), প্রসবকালীন ও প্রসব-উত্তর (প্রসবের পরবর্তী ৪২ দিন) অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব প্রসূতিকে জরুরি সেবাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। সদ্য প্রসূতি মা (ছয় সপ্তাহের মধ্যে) এবং শিশুদের (বিশেষত মারাত্মক পুষ্টিহীন, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া ও হামে আক্রান্ত) ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল প্রদান করা হয় এ ক্লিনিকগুলোয়। এছাড়া নারী ও কিশোরীদের রক্তশূন্যতা চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দেয়া হয়। এ ক্লিনিকগুলোয় শিশুদের প্রতিষেধক এবং ১৫-৪০ বছর বয়সী নারীদের ধনুষ্টংকারের টিকা দেয়াসহ ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে সন্দেহজনক এএফপি (হাত-পা বা যে কোনো অঙ্গ হঠাৎ অবশ হওয়া বা দুর্বল হওয়া) শনাক্ত করার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

কমিউনিটি ক্লিনিকে নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানসহ আগ্রহী নারীদের আইইউডি স্থাপন, প্রথম ডোজ গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রদান এবং জš§নিরোধকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। খাবার বড়ি, কনডম প্রভৃতি অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ সার্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে। যারা কোনো কারণে বর্তমানে খাবার বড়ি বা অন্য কোনো কারণে পদ্ধতি গ্রহণ করছেন না কিংবা যক্ষ্মা, কুষ্ঠ প্রভৃতি রোগের কারণে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অথবা যারা ওষুধ সেবনের জন্য আসছেন না অথবা গর্ভবতী নারীরা প্রসবপূর্ব বা প্রসব-উত্তর সেবা গ্রহণ করেননি, তাদের খুঁজে বের করে পুনরায় চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা এ ক্লিনিকের কাজ। এর বাইরেও পারিবারিক পর্যায়ে শয্যাশায়ী রোগীদের যারা সেবা দেন, তাদের প্রশিক্ষণ ও বয়স্কদের সংগঠিত করে ব্যায়াম ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা হয় এ ক্লিনিকগুলোয়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট।

সেবাগ্রহীতাদের সেবা গ্রহণ সহজতর করতে সরকার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি করে ল্যাপটপ সরবরাহ করেছে। ফলে সেবাগ্রহীতারা অনলাইনে বিভিন্ন রিপোর্ট ও তথ্য পেয়ে থাকেন। এ ক্লিনিক মূলত জনগণ ও সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত একটি সমন্বিত কার্যক্রম। কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যসেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রতি ছয় হাজার জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আজ আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হয় না; কেননা ঘরের পাশেই আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আমরাও চাই দেশের হাজারো মা-বোন তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে নিশ্চিন্তে থাকুক। হাসিমুখে প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে আসুক আবার।

পিআইডি নিবন্ধ