Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:45 pm

কমিশনের বিনিময়ে নানা অবৈধ সুবিধা নেয় কোম্পানিগুলো!

বিদ্যুৎ খাতে গত দেড় দশকে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যদিও এসব অভিযোগ কখনোই তদন্ত করা হয়নি। বরং দায়মুক্তি আইনে দুর্নীতিবাজদের সব ধরনের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির প্রক্রিয়া ও কার্যকারণ উšে§াচনে সম্প্রতি অনুসন্ধান চালায় শেয়ার বিজ। এর ভিত্তিতে আজ থাকছে ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: দরপত্র ছাড়া লাইসেন্স দেয়া বা নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম। বরং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় প্রতিটি ধাপে ধাপে কোম্পানিগুলো নিয়েছে নানা অবৈধ সুযোগ। কমিশনের বিনিময়ে সময়ে সময়ে এসব সুযোগ দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হলেও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সংশ্লিষ্টদের পকেট। এছাড়া বাড়তি পাওনা হিসেবে অবসরের পর বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোয় চাকরিও নিয়েছেন পিডিবির অনেক কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে অনুমোদন দেয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণে বড় অঙ্কের কমিশন লেনদেন হয়। এ সুযোগে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারে নির্ধারণ করে নেয়। সে সময় ডলারের বিনিময় হার ছিল ৪৮-৫০ টাকা। তবে দফায় দফায় চুক্তি নবায়নের ফলে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলেছে ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে। এতে ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দেশীয় মুদ্রা তথা টাকায় বিনিয়োগ করেও ডলারে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে প্রচুর মুনাফা করেছে কোম্পানিগুলো। আর এ ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই বৈধ বা অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে গেছে। তবে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি কোম্পানিগুলো। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে আরও এক দফা অর্থ আদায় হাতিয়ে নিয়েছে তারা। আর সে অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করা হয়নি। মূলত এ অর্থগুলোও দেশের বাইরে পাচার হয়েছে।

এদিকে একই বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে চার দফা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে কোম্পানিগুলো। পিডিবির সঙ্গে সম্পাদিত এ-সংক্রান্ত চুক্তি বিশ্লেষণ করলে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, যা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। ধরা যাক, লাইসেন্স পাওয়ার পর কোনো একটি কোম্পানি ‘এক্স’ একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করল, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। তিন বছরের জন্য রেন্টাল ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় ৩০০ কোটি টাকা হলেও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিনিয়োগ লেগেছে মোট ব্যয়ের ২৫-৩০ শতাংশ বা মাত্র ৭৫ থেকে ৯০ কোটি টাকা, যাকে ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট বলা হয়েছে চুক্তিতে। বাকি অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয়।

পিডিবি তথা সরকার সুদসহ সেই ঋণ (চুক্তি অনুযায়ী) তিন বছরে পরিশোধ করে দেয়। পাশাপাশি ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অন ইক্যুইটি)। এভাবে প্রতি বছর সরকার যে টাকাটা পরিশোধ করেছে সেটাই ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ। তবে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় পরিশোধ করলেও এর মালিকানা ওই কোম্পানি ‘এক্স’-এর কাছেই রয়ে যায়। যদিও মেয়াদ শেষে আবারও চলেছে চুক্তি নবায়ন।
নবায়নকৃত চুক্তির নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, হয়তো তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা)। কিন্তু চুক্তিকালীন সময়ে (তিন বছরে) এর ৩০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। এতে মেয়াদ শেষে ওই কোম্পানি আবেদন করে চুক্তি নবায়নের। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা অবশিষ্ট রয়ে গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই কোম্পানির সঙ্গে আরও দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় পরিশোধ করা হয়ে গেলেও নতুন করে আবারও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।

পরবর্তী দুই বছরে ওই কেন্দ্রের সক্ষমতার আরও হয়তো ২০ শতাংশ বা দুই হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা ব্যবহার করা হয়। তখন ওই কোম্পানি আবার আবেদন করে চুক্তি নবায়নের। তখন হয়তো পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়। সে সময়ও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়। তবে পরিমাণে কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়। ওই সময়ে হয়তো বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার আরও ৩০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। তখন ওই কোম্পানি আবার আবেদন করে এবং আবার চুক্তি নবায়ন হয় দুই বছরের জন্য। আবার তাকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।
এভাবেই তিন বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্র ১২ বছর ধরে চলেছে। তবে ১৫-১৭ বছর পর্যন্ত চলছে কিছু রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর এভাবেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চার দফা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে ওই কোম্পানি। ফলে নামমাত্র বিনিয়োগ করেও ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি অর্থ তুলে নেয়া হয়। আর বারবার চুক্তি নবায়নের সুযোগ করে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও পিডিবির কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের কমিশন পকেটে ভরেছেন।

অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে উৎপাদনে গিয়ে বিপাকে পড়ে বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানিগুলো। নিম্নমানের যন্ত্রপাতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাক্সিক্ষত হিটরেট না পাওয়ায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল ব্যবহার করতে হচ্ছিল তাদের। তবে তেলের বাড়তি বিল দিতে অস্বীকৃতি জানায় পিডিবি। তবে সামিট, ইউনাইটেড, ডরিনসহ বেসরকারি কোম্পানিগুলো তখন বিকল্প ফন্দি আঁটে। তারা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আমদানিকৃত তেলের মান খারাপ বলে দাবি করে।


এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসির আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েল পরীক্ষা করে গুণগত মান সঠিক পাওয়া গেলে বিপদে পড়ে কোম্পানিগুলো। তখন তারা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষার মান ঠিক না বলে দাবি করে এবং দেশের বাইরে তিনটি দেশ থেকে বিপিসির আমদানিকৃত তেল পরীক্ষার দাবি তুলে। অন্যথায় সরাসরি তেল আমদানির সুযোগ চায় কোম্পানিগুলো। উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত জ্বালানি তেলের ৮৫ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজেরা আমদানির সুযোগ নেয়। বাকি ১৫ শতাংশ বিপিসি থেকে কিনতে হয়। এক্ষেত্রে তেল বেশি ব্যবহার হলেও বিকল্প উপায়ে মুনাফা তুলে নেয়া শুরু করে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। এজন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে দিয়ে তারা একটি অর্ডার করিয়ে নেয়। এর আওতায় আমদানিকৃত তেলের দাম ডলারে পরিশোধের পাশাপাশি পিডিবিকে দিতে হয় সার্ভিস চার্জ। মূলত আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যয় বহনে ৯ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এছাড়া বন্দর চার্জ, জাহাজ ভাড়া এসব আলাদা পায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

সার্ভিস চার্জের মধ্যে তেল মজুত, বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন, ব্যাংক চার্জ, ব্যাংক ঋণের সুদ ইত্যাদি রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে লাইবর রেটে তুলনামূলক কম সুদে ঋণ নিলেও ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আদায় করে ক্ষতি পুষিয়ে উল্টো লাভ করে কোম্পানিগুলো। এভাবেই একের পর এক বাড়তি সুবিধা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের কমিশন।

এখানেই শেষ নয়, বরং পিডিবির বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান, সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবসরের পর বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিতে পরামর্শক হিসেবে কাজও নিয়েছেন। মূলত চাকরিতে বহাল অবস্থায় দেয়া সুবিধার প্রতিদান অথবা পিডিবিতে প্রভাব খাটিয়ে নতুন কোনো সুবিধা আদায় করে দেয়ার শর্তে তারা এসব পদ নিয়েছেন বলেই জানা গেছে।