নিজস্ব প্রতিবেদক : সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালত হয় ২০১৬ সালে। ওই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দেশে উচ্চ দারিদ্র্য হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর নি¤œ দারিদ্র্য হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ছয় বছর পর ২০২২ সালে ফের এ জরিপ পরিচালিত হলো। এই জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নি¤œ দারিদ্র্য বা চরম দারিদ্র্য অনেক বেশি হারে হ্রাস পেয়েছে। এবার নি¤œ দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ। আর উচ্চ দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক সাত শতংশ। তবে দারিদ্র্য হার কমলেও দেশে আয় ও ভোগ বৈষম্য বেড়েছে।
২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের (হেইস) ফলাফলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কার্যালয়ে গতকাল এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাউসার আহাম্মদ এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘খানার আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’-এর প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়ের মধ্যে নি¤œদারিদ্র্য যে হারে হ্রাস পেয়েছিল, ২০১৬ থেকে ২০২২ সময়ে তার চেয়ে বেশি দ্রুত হারে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। ২০১০ থেকে ১৬ সময়ে বছরে নি¤œ দারিদ্র্য হার হ্রাসের মাত্রা ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর ২০১৬ থেকে ২০২২ সময়ে এটি হ্রাস পেয়েছে প্রতি বছর ১.২২ শতাংশ হারে। অথচ এ সময়ে দেশে কভিডের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছিল। ফলে প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়ে স্বাভাবিক গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও একটি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা অস্বাভাবিক সময়ে দারিদ্র্য কী কারণে দ্রুত হ্রাস পেল সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে নির্দিষ্ট কোনো জবাব দেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার করোনার সময়ে নানা ধরনের সহায়তা কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল। এর পাশাপাশি প্রণোদনা কার্যক্রম ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ করা হয়েছিলো। সরকারের নানা দ্রুত পদক্ষেপের কারণে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।
জরিপের তথ্য মতে, ৬ বছর পর দেশে প্রতি পরিবারে খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ২০২২ সালে একটি পরিবারের বিবিএস সারাদেশের ৭২০টি নমুনা এলাকায় এ জরিপ পরিচালিত হয়। প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০টি করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপটি ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর সময়ে করা হয়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিকভাবে ২০২২ সালে দেশের পল্লী এলাকাগুলোতে দারিদ্র্য হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের জরিপে পল্লি এলাকায় দারিদ্র্যের হার ২৬.৪ এবং শহর এলাকায় এই হার ১৮.৯ শতাংশ। অপরদিকে ২০২২ সালে পল্লি এলাকায় অতিদ্রারিদ্যের হার ৬.৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৩.৮ শতাংশ।
বিবিএসের ওই জরিপ বলছে, ২০২২ সালে একটি পরিবারে যে আয় হয়, তার প্রায় অর্ধেকই চলে যায় খাদ্যপণ্য কিনতে। অর্থাৎ খাদ্যপণ্য কেনায় একটি পরিবারে ব্যয় হয় ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে এই ব্যয় খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ভোগ্যপণ্য সম্পর্কিত ব্যয়ের থেকে কম। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ভোগ্যপণ্যের পেছনে খরচ বেড়েছে। শতাংশের হারে তা ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৬ সালে যা ছিল যথাক্রমে খাদ্যপণ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে বর্তমানে জনপ্রতি দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ইতিবাচকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে জনপ্রতি ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ দৈনিক দুই হাজার ৩৯৩ কিলোক্যালরি, যা ২০১৬ সালে ছিল দুই হাজার ২১০ কিলোক্যালরি।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে জরিপে অংশগ্রহণ করা খানার আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে বর্তমানে খানার গড় মাসিক আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা; যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ ও ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।
খানার আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছর বেড়েছে বৈষম্য। মূলত বৈষম্যকে হিসাব জিনি সহগের মান দিয়ে। জিনি সহগের মান যত বেশি হবে তত ওই সমাজে বৈষম্য বাড়বে বলে ধরা হয়। বর্তমানে আয়ের জন্য জিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। এতে দেখা যায় বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ভোগব্যয়ের জন্য জিনি সহগের মান শূন্য ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২১।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের কারণে দেশের দারিদ্র্যের হার কমেছে। তার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে আজকের প্রতিবেদনে। আমরা করোনার প্রকোপ কাটিয়ে ওঠেছি। সরকারের প্রণোদনা ও বিনামূল্যে খাদ্য প্রদানের কারণে। আমরা করোনার সময় মিল কলকারখানা বন্ধ করেনি যেটা অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। যার ফল আজকে ভোগ করছি।’
প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘গ্রামে দারিদ্র্যের হার কমেছে এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তবে সরকারের বেশিরভাগ সুফল ভোগ করেছে গ্রামের তাই দারিদ্র্য শহরের তুলনায় কমেছে। তিনি আরও বলেন, বিবিএসের তথ্য নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তারা মাঠে গিয়ে কাজ করে ফলাফল দেয়। তথ্য বানানো-দেখানোর কিছু নেই এখানে।’