রোহান রাজিব: ডলার সংকটে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে লাগাম টানার উদ্যোগের ফলে দেশের আমদানি কমেছে। আগের চেয়ে কমেছে কোনো কোনো পণ্যের আমদানিও। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খাদ্যশস্য ১৬ শতাংশ এবং মূলধনি পণ্যের ১১ শতাংশ আমদানি কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিকভাবে আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ২০ শতাংশ কমে ৪ হাজার ১১৯ কোটি ডলারে নেমেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে ব্যয় হয় ৪ হাজার ২১২ কোটি ডলার।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যশস্য ও মূলধনি আমদানি কমেছে ডলার সংকটের কারণে। ব্যাংকে ডলারের অনিশ্চয়তা রয়েছে। এলসি খুলতেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের ওঠানামা করছে। এসব কারণে আমদানি কমেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে খাদ্যশস্যের আমদানিতে ১৩২ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময় এ ব্যয় ছিল ১৫৮ কোটি ডলার। ফলে খাদ্যশস্যের আমদানি ব্যয় কমেছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময়ে চাল আমদানি ১ দশমিক ৮ শতাংশ ও গম ২১ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পরিসংখ্যানে দুই সময়কালে কত টন চাল ও গম আমদানি হয়েছে তা নেই।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মূলধনি পণ্যের আমদানি কমেছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ। এর মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ছয় মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৬৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় ছিল ২৭৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে অন্যান্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিকভাবে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ। এ সময়ে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১৭৫ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভোজ্যতেল আমদানি ব্যয় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে এ সময় চিনির আমদানি ব্যয় ২১ শতাংশ কমেছে। ছয় মাসে চিনি ৪১ কোটি ডলার। গত অর্থবছর একই সময় ছিল ৫২ কোটি ডলার। ডালের আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩৮ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময় থেকে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
সরকার অতিপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। বেশ কিছু পণ্যে বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। তবে কৃষির প্রয়োজনে সার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এর আমদানিতে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়নি। জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে ৩৩৮ কোটি ডলারের সার আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে সার আমদানির জন্য ব্যয় হয় ২০২ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অবশ্য গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
এদিকে মধ্যবর্তী পণ্য বিশেষত শিল্পের কাঁচামালে আমদানি ব্যয় কমেছে। ছয় মাসে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫০১ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৫৪৮ কোটি ডলার। মধ্যবর্তী পণ্যের মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় কমেছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের একই সময়ের ৪৯ কোটি ডলার থেকে ৪৬ কোটি ডলারে নেমেছে। তবে তৈরি পোশাকসহ কিছু শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। তুলা আমদানি হয়েছে ২৬৮ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের ছয় মাসের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে অন্যান্য মধ্যবর্তী পণ্য বেড়েছে ৫ শতাংশ। তবে ছয় মাসে তেলবীজ আমদানি ২৩ শতাংশ, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য ৭৪ শতাংশ ও প্লাস্টিক এবং রাবারের সামগ্রী ১০ শতাংশ কমেছে।
আমদানি কমাতে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের শুল্কহার বাড়িয়েছে সরকার। বেশ কিছু পণ্য আমদানির এলসির সময় শতভাগ ও ৭৫ শতাংশ নগদ জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর গত আগস্ট মাস থেকে বড় এলসির পণ্য ধরে ধরে যাচাই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে পণ্য আমদানির এলসির ক্ষেত্রে যে দর দেয়া হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, ডলার সংস্থান হবে কীভাবেÑযে পণ্য আনা হচ্ছে তার প্রয়োজনীয়তাসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই করে অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি কিছুটা কমে এসেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫২৭ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চলতি হিসাব-ভারসাম্যে ঘাটতি কমেছে ৩০২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
চলতি হিসাবের পাশাপাশি পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণও কমেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৩০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ছয় মাসের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৩৪০ কোটি ডলার।
এদিকে, নানা পদক্ষেপের কারণে ২০২২ সালে নতুন এলসি খোলা ৫২ শতাংশ কমেছে। এসব পণ্য আমদানি কমার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হলে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়ন্ত্রণ করার কারণে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। তারা অনেক অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারেনি। এলসি খোলা কমার ফলে এসব পণ্যে আমদানি কমেছে। এমন কমতে থাকলে আগামী দিনে উৎপাদনমুখী খাত ও খাদ্যপণ্যে অনেক প্রভাব তৈরি হবে।