Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 10:28 am

কম দরে আইএফআইসির শেয়ার বিক্রি কার স্বার্থে?

শেখ আবু তালেব: নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি নিয়ে চলছে একের পর এক কেলেঙ্কারি। সর্বোচ্চ দরদাতাকে শেয়ার না দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছে বিক্রিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আইএফআইসি। সরকারের মালিকানা থাকায় কম দামে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে সরকারের লোকসান হতে যাচ্ছে মিলিয়ন ডলার।

যদিও একটি শিল্পগ্রুপ প্রস্তাব দিয়েছে যেকোনো মূল্যে তারা শেয়ার ক্রয় করতে রাজি, তবে সর্বনিম্ন দরতাদাকে শেয়ার পাইয়ে দিতে অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন বিক্রয় কাজে জড়িত ব্যাংকাররা। আর শেয়ার বিক্রি বন্ধ এবং নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে না আনতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে নেপালের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।

এদিকে শেয়ার বিক্রি বন্ধে নেপালের কাঠমান্ডু ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট (কেডিসি) আদেশ দিয়েছে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ ও নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের প্রতি।

জানা গেছে, নেপাল ও বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠা পায় ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড (এনবিবিএল)’। এটি নেপালের জনগণের কাছে পরিচিতি পায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এনবিবিএল ইনভেস্টমেন্ট ও এনবিবিএল সিকিউরিটিজ নামে ব্যাংকটির দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিও রয়েছে। এনবিবিএল নেপালের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

এদিকে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের আইএফআইসি। ব্যাংকটিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা শেয়ার রয়েছে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি বছর মিলিয়ন ডলারের লভ্যাংশ পাচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক, যা রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে দেশে। তারপরও ব্যাংকটি থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক।

গত বছর আইএফআইসি ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেবে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে আনবে আইএফআইসি ব্যাংক। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জানাতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কাছে তথ্যও দেয় আইএফআইসি। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে তা প্রকাশ করে ডিএসই। অপরদিকে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকও সে দেশে তালিকাভুক্ত। এজন্য আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির তথ্য নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জেও প্রকাশ করা হয়।

শেয়ার বিক্রির তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরই নেপালের শিল্পগ্রুপ এমভি দুগার গ্রুপের চেয়ারম্যান মতিলাল দুগার আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে যোগাযোগ শুরু করে। একপর্যায়ে চূড়ান্ত হয় আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার কিনবে মতিলাল দুগার। কিন্তু শেষ পর্যায়ে মতিলাল দুগারকে শেয়ার না দিয়ে বিক্রি করা হয় নাবিল গ্রুপের কাছে। প্রতি শেয়ার বিক্রিতে মতিলালের প্রস্তাব ছিল ১৬০ নেপালি রুপি। আর এনবি গ্রুপ এ শেয়ার কিনতে চেয়েছিল ১৬১ রুপিতে। কিন্তু নাবিল গ্রুপের কাছে শেয়ার বিক্রিতে চুক্তি করা হয় প্রতিটি ১৫৭ রুপি।

এদিকে শেয়ার বিক্রির ঘোষণার পরপরই শঙ্কর গ্রুপ প্রস্তাব করে যেকোনো মূল্যে (আইএফআইসি ব্যাংকের চাওয়া মূল্যে) সব শেয়ার কিনবে। কিন্তু সেই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি আইএফআইসি ব্যাংক। উপায় না পেয়ে গত ১১ জানুয়ারি নেপালের আদালতে রিট করে মতিলাল দুগার। এতে শেয়ার বিক্রয় প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু আদালতের দেয়া রায় উপেক্ষা করে গত ১৩ জানুয়ারি চৌধুরি গ্রুপের মালিকানাধীন নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক। নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করতে এ চুক্তি করা হয়। আইএফসিআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির পর নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক দেশটির নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে।

জানা গেছে, দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে প্রতিটি ১৫৭ রুপিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। উপায়ান্তর না পেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ চেয়েছে নেপালের ব্যাবসায়ী সংগঠন নেপাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।

অপরদিকে মতিলাল দুগার ও শঙ্কর গ্রুপের পক্ষ থেকে নেপাালে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়। সেখানে সার্বিক বিষয়টি অবহিত করে লিখিত আকারে দেয় শিল্পগ্রুপ দুটি। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে জানানোর জন্য উদ্যোগ নিতে বলা হয়।

লিখিত চিঠি, আইএফআইসি ব্যাংক ও কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট শেয়ারের মধ্যে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ হচ্ছে আইএফআইসির, যার পরিমাণ হচ্ছে তিন কোটি ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২৬টি। সম্প্রতি সর্বশেষ হিসাববছরের জন্য ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নতুন পাওয়া বোনাস শেয়ার মিলিয়ে আইএফআইসির মোট শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে চার কোটি ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৭টি।

এদিকে মতিলাল দুগারের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শেয়ার ক্রয়ে গত বছরের শুরু থেকে আইএফআইসি ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক দফায় চিঠি চালাচালি হয়। টেলিফোন, ইমেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে চূড়ান্ত হয় শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি। এতে সময় চলে যায় দীর্ঘ ৯ মাস। আলোচনার পরে মতিলাল দুগারকে জানানো হয় লিখিত প্রস্তাব দিতে। একইসঙ্গে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে আইনি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ঢাকায় আইনজীবী নিয়োগের জন্য বলা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের পক্ষ থেকে। সে অনুযায়ী মতিলাল দুগার লিখিত প্রস্তাব দেয়ার পাশাপাশি আইনজীবী নিয়োগ দেয়। কিন্তু তার কাছে শেয়ার বিক্রি না করে নাবিল গ্রুপের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক।

এ বিষয়ে নেপাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এলবি শ্রেষ্ঠা শেয়ার বিজকে মুঠোফোনে জানান, ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে দুর্নীতি হচ্ছে। এতে ব্যাংকাররা অনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে। আর্থিক লেনদেনও হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নেপালের দুর্নীতি দমন ব্যুরোতেও অভিযোগ দেয়া হয়েছে। জমি কেনা থেকে শুরু করে শেয়ার বিক্রিতে প্রতিটি ধাপেই চলছে অনিয়ম। বিষয়টি নিয়ে নেপালের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচকভাবে প্রচার পাচ্ছে। এতে নেপালের জনগণের কাছে বাংলাদেশের সম্মান ক্ষুণœ হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা।’ এ বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম সরওয়ারের সঙ্গে গতকালও একাধিকবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।