কম ব্যয়ের পরিবর্তে মাস্টারপ্ল্যানে উচ্চ ব্যয়ের উৎপাদন পরিকল্পনা!

২০১০ ও ২০১৬ সালের পর আবারও বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করল বর্তমান সরকার। তবে এবারই প্রথম বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি পরিকল্পনাও সমন্বিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি) ২০২৩ সম্প্রতি অনুমোদন করেছে সরকার, যার খুঁটিনাটি দিক নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

ইসমাইল আলী: দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গত দুই বছরে এ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এজন্য কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এরপরও উচ্চ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। তবে গত ২৭ নভেম্বর অনুমোদিত ‘সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি) ২০২৩’-এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর কোনো নির্দেশনা নেই। বরং কম ব্যয়ের পরিবর্তে উচ্চ ব্যয়ের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
২০১০ ও ২০১৬ সালে শুধু বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল। তবে এবারই প্রথম জ্বালানি ও বিদ্যুতের জন্য সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। তবে এ মাস্টারপ্ল্যানে আগের মতোই প্রায় দেড়গুণ উৎপাদন সক্ষমতার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে ২০৫০ সাল নাগাদ বসে থাকবে চাহিদার তুলনায় প্রায় ৫৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার কেন্দ্র।

অন্যদিকে কম ব্যয়ের ও সহজলভ্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে ব্যয়বহুল ও নতুন প্রযুক্তির কার্বন ক্যাপচার সিস্টেম (সিসিএস), হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও এসব প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। খোদ মাস্টারপ্ল্যানেই ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক ২০২১-এর তথ্যের ভিত্তিতে তা তুলে ধরা হয়েছে।

মাস্টারপ্ল্যানের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় চার সেন্ট। কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ব্যয় চার দশমিক ৭ সেন্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পাঁচ দশমিক ২ সেন্ট, বায়ুবিদ্যুৎ (অনশোর) পাঁচ দশমিক ৯ সেন্ট, গ্যাস/এলএনজি দিয়ে ছয় দশমিক ২ সেন্ট, গ্যাস+সিসিএস আট দশমিক ৪ সেন্ট, বায়ুবিদ্যুৎ (অফশোর) ১৩ দশমিক ৮ সেন্ট, হাইড্রোজেনে ১৪ সেন্ট এবং অ্যামোনিয়া দিয়ে ১৭ সেন্ট।

যদিও মাস্টারপ্ল্যানে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ধরা হয়েছে মাত্র ছয় হাজার মেগাওয়াট। আর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াট। তবে অনশোরে এ ব্যয় অনেক কম হলেও, মাস্টারপ্ল্যানে অফশোরেই বায়ুবিদ্যুৎ অধিক পরিমাণে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। অনশোরে তা তুলনামূলক অনেক কম ধরা হয়েছে। এছাড়া গ্যাস+সিসিএস প্রযুক্তিতে ছয় হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ধরা হয়েছে। যদিও জাপানের প্রস্তাবিত এ প্রযুক্তি বিশ্বের বহু দেশেই বাতিল করা হয়েছে। আবার এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও অনেক বেশি।

এদিকে বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া দিয়ে। তারপরও এ দুই প্রযুক্তি দিয়ে যথাক্রমে তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট ও দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। অথচ এ দুই প্রযুক্তি বাতিল করে মাস্টারপ্ল্যানে নবায়নযোগ্য তথা সৌরবিদ্যুতের অংশ বাড়ানোর জন্য কয়েক দফা প্রস্তাব করেছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।

মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সৌরবিদ্যুতের প্রতি ইউনিট উৎপাদন ব্যয় ছিল চার সেন্ট। তবে আগামীতে তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। এতে ২০৩০ সালে সৌরবিদ্যুতের প্রতি ইউনিট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে দুই দশমিক ৭ সেন্ট, ২০৪০ সালে দুই দশমিক ৪ সেন্ট ও ২০৫০ সালে দুই দশমিক ১ সেন্ট। একইভাবে অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও কমবে। ২০২০ সালে অফশোর বায়ুবিদ্যুতের প্রতি ইউনিট উৎপাদন ব্যয় ১৩ দশমিক ৮ সেন্ট থাকলেও ২০৩০ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৪ সেন্ট। ২০৪০ সালে এ ব্যয় আরও কমে দাঁড়াবে আট দশমিক ৩ সেন্ট ও ২০৫০ সালে সাত দশমিক ২ সেন্ট।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদন ব্যয় এতটা কমে আসার সম্ভাবনা থাকার পরও কেন কম উৎপাদনের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে, তা বোধ্যগম্য নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) সদস্য সচিব হাসান মেহেদী শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আইইপিএমপি ২০২৩ সরকারের প্রণীত মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৫০ সাল নাগাদ উৎপাদিত বিদ্যুতের শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে আইইপিএমপিতে ২০৫০ সালে উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশের কম আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে।

আইইপিএমপি ২০২৩ নিয়ে চলতি বছর শুরুর দিকে এক নীতি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে উপকূলীয় পরিবেশ ও জীবনযাত্রা কর্মজোট (ক্লিন) এবং বিডব্লিউজিইডি। এতে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারের মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশ ও ২০৫০ সাল নাগাদ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বিগত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ আইইপিএমপিতে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি (বিশেষত কয়লা ও এলএনজি), ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ তথাকথিত ‘উন্নততর প্রযুক্তি’ (বিশেষত তরল হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও কার্বন সংরক্ষণ প্রযুক্তি) এবং মাত্র ১৭ দশমিক ১ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০