ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের পর কয়লাভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেগুলোর বড় অংশই সময়মতো উৎপাদনে আসেনি। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র বাতিল ঘোষণা করা হয় গত জুনে। আরও কয়েকটি কেন্দ্র বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে অনেকটা সরে আসার ঘোষণা দেয়া হয়। যদিও বাস্তবে তেমনটি হচ্ছে না।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে এখনও সরে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং রাষ্ট্রায়ত্ত দুই সংস্থা দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া নির্মাণকাজ চলছে আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। ২০৩০ সালের জন্য নির্ধারিত বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় রয়েছে কয়লাভিত্তিক এসব কেন্দ্র। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ‘বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির তথ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ বর্তমানে চলছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছয় হাজার ৪৬২ মেগাওয়াট। আরও তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে একটি বেসরকারি ও দুটি সরকারি। এ তিন কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ১৫৫ মেগাওয়াট। অর্থাৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে ৯ হাজার ৬১৭ মেগাওয়াট।
এর বাইরে ২০২০ সালে উৎপাদনে আসে পায়রার কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বাংলাদেশ-চীনের যৌথ প্রকল্প এটি। এর আগে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ছিল দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থাৎ নতুন আর অনুমোদন দেয়া না হলেও কয়েক বছরের মধ্যে দেশের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ১১ হাজার ৪৬২ মেগাওয়াট।
এদিকে গত জুনে বাতিল করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল আট হাজার ৭১১ মেগাওয়াট। প্রকল্পগুলো হলোÑপটুয়াখালী এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, উত্তরবঙ্গ এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র, চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী এক হাজার ৩২০ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর যৌথ উদ্যোগের ৭০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সিপিজিসিবিএলের (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি) এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, উৎপাদনে আসার তালিকায় থাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রামপালে নির্মাণ করা হচ্ছে এক হাজার ২৪০ মেগাওয়াটের মৈত্রী সুপার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি। এর অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। এ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট চলতি মাসে ও দ্বিতীয় ইউনিট জুলাইয়ে চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও দ্বিতীয় ইউনিটটি ওই বছর জুলাইয়ের চালুর কথা রয়েছে।
পটুয়াখালীতে বাংলাদেশের আরপিসিএল (রুরাল পাওয়ার কোম্পানি) ও চীনের নরিনকো যৌথভাবে নির্মাণ করছে এক হাজার ২৪৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। আগামী বছর আগস্টে এর প্রথম ইউনিট ও ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আর পটুয়াখালীতে এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াটের আগেরটি বিদ্যুৎকেন্দ্র যৌথভাবে নির্মাণ করছে বাংলাদেশের এনডব্লিউপিজিসিএল (নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি) ও চীনের সিএমসি। এ প্রকল্পের অগ্রগতি ২০ তাংশ। এর প্রথম ইউনিট আগামী বছর জুনে ও দ্বিতীয় ইউনিট ডিসেম্বরে চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার চলতি বছর ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রের অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ। আর বরিশাল ইলেকট্রিক কোম্পানির নির্মাণাধীন ৩০৭ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। এ কেন্দ্রটি চলতি বছর জুলাইয়ে উৎপাদনে আসার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
সূত্রমতে, উল্লিখিত ছয়টি কেন্দ্রের বাইরে ওরিয়ন গ্রুপ ৬৩৫ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এটি নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। তবে বাস্তবে এর কোনো অগ্রগতি নাই। এটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে চালুর লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
এদিকে মহেশখালীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় পিডিবি। ইসিএ অর্থায়নে (ঋণ) এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২৭ সালের জুনে কেন্দ্রটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে এর দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক কোম্পানি সিপিজিসিবিএল মাতারবাড়ীতে আরেকটি এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। বর্তমানে এর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। ২০২৮ সালের জুনে এটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এর বাইরে ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মাণ করা হচ্ছে আদানি গ্রুপের এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারতে নির্মাণ করা হলেও এ কেন্দ্রের বিদ্যুতের পুরোটা বাংলাদেশে রপ্তানি করা হবে। এ কেন্দ্রটির অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। এর প্রথম ইউনিট চলতি বছর আগস্টে ও দ্বিতীয় ইউনিট ডিসেম্বরে চালুর কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, বিভিন্ন দিক যাচাই-বাছাই করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে যেগুলো নির্মাণাধীন ছিল সেগুলো বহাল রাখা হয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি কেন্দ্র বাতিল করা হবে নাকি নির্মাণ করা হবে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই চাহিদা অনুপাতে কয়েকটি কেন্দ্র বাতিল নাও হতে পারে।