কয়লার দাম নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশে আদানির দল!

ইসমাইল আলী: আদানির ঝাড়খন্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আগামী মাসে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। এ কেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ধরা হয়েছে বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। তাই আদানির কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি জানায় বাংলাদেশ। অবশেষে কয়লার দাম নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে এসেছে আদানির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। এখন বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) পর্যালোচনা করা হবে।

সূত্র জানায়, কয়লার উচ্চ দাম ধরায় আদানির বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্চা যাবে মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তবে গচ্চা দিয়ে এ বিদ্যুৎ কিনতে রাজি নয় পিডিবি। এজন্য চুক্তি সংশোধনে গত মাসে আদানিকে চিঠি দেয় সংস্থাটি। এতে আদানি ও পিডিবির মধ্যে সম্পাদিত পিপিএ সংশোধনের কথা বলা হয়। চুক্তি সংশোধনের আগে আদানির বিদ্যুৎ কেনার জন্য চাহিদা দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আদানির প্রতিনিধিদল গতকাল ঢাকায় আসে। গতকালই পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল কয়লার দাম নিয়ে আলোচনার জন্য পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে। এতে আদানির একজন প্রধান নির্বাহী ও একজন প্রধান ক্রয় (প্রকিউরমেন্ট) কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আদানির ঢাকা অফিসের একজন কর্মকর্তাও বৈঠকে যোগ দেন।

পিডিবির প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) ও সদস্য (ফাইন্যান্স) ছাড়াও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। বৈঠকে উভয় পক্ষ তাদের নিজ নিজ পক্ষের যুক্তিতর্ক ও অবস্থান তুলে ধরে। তবে সংবেদনশীল হওয়ায় বৈঠকের আলোচনার সারমর্ম গোপন রাখা হয়।

সূত্র জানায়, উভয় পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বৈঠকে একমত হয়। এ সময় আদানির প্রতিনিধিদল জানায়, তারা কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে পিপিএ সংশোধনের বিষয়ে পিডিবির অবস্থান আদানির শীর্ষ নির্বাহীর কাছে তুলে ধরবে। এছাড়া আদানির প্রতিনিধিদল পিডিবির আপত্তির বিষয়ে একমত হয়েছে বলেও জানা যায়।

বৈঠক শেষে আদানির প্রতিনিধিদল পিডিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এছাড়া তারা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে।

পিডিবির তথ্যমতে, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হয়। এতে দাম পড়ে প্রতি মেট্রিক টন ২৩৭ ডলার। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দর প্রস্তাব জমা পড়েছে চলতি মাসে। এতে প্রতি মেট্রিক টনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩২ ডলার। অথচ আদানি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম প্রস্তাব করেছে ৪০০ ডলার। অর্থাৎ রামপালের প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রস্তাব করেছে আদানি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম নিন্মমুখী। অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আনলেও এর দাম কোনোভাবেই ২৫০ ডলারের বেশি হবে না। এক্ষেত্রে কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করে দাম নির্ধারণের কথা বলা হয়। এজন্য প্রয়োজনে চুক্তি সংশোধনের কথাও জানানো হয়।

সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর) হলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা আর আদানির কেন্দ্রে ১৯ টাকা ৬২ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ছে ৫ টাকা ৭৩ পয়সা বা ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এদিকে কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পিডিবি দেয়ায়, নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।

পায়রার এ চুক্তির শর্ত দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। ফলে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা (এক ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)। তাই পিপিএ সংশোধন না করলে আদানিকে বিদ্যুতের চাহিদা দেয়া হবে না। প্রয়োজনে বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে।

তথ্যমতে, আদানির কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারের দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির শর্তের কারণে আরও সুবিধা পাবে আদানি। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে পিডিবি কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে কয়লার দাম দিলেও এর মালিকানা পিডিবি পাবে কিনা তা চুক্তিতে বলা হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি শেয়ার বিজে ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি: কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!’।

যদিও শুধু কয়লার দামই বেশি চায়নি আদানি। বরং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে ভারতের এ কোম্পানিটি। ১২ ফেব্রুয়ারি শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘চুক্তির শর্ত ভঙ্গ: করছাড় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণায় আদানি!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাবে আদানি। এতে কমবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয়। তাই কর-ছাড়ের বিষয়টি বাংলাদেশকে ৩০ দিনের মধ্যে জানানোর শর্ত থাকলেও জানানো হয়নি ৩ বছরে। মূলত বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার দাম নেয়ার জন্য প্রতারণা করেছে আদানি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০