ইসমাইল আলী : ছয় মাস আগে স্পট মার্কেটে কয়লার দাম উঠেছিল প্রতি টন ৪০৭ ডলারে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ স্তিমিত হয়ে আসায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে টানা নিম্নমুখী এ জ্বালানি পণ্যের দাম। বর্তমানে স্পট মার্কেটে কয়লার দাম নেমেছে ১৮০ ডলারের নিচে। তবে নিম্নমুখী কয়লার দামের এ সুযোগ নিতে পারছে না বাংলাদেশ। বরং ডলার সংকটে কয়লা আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে একে একে বন্ধ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে বর্ধিষ্ণু তাপমাত্রায় আবারও চোখ রাঙাচ্ছে লোডশেডিং।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয় পড়বে। সাধারণ মানুষ যেমন লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বে, পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিউক্যাসেল ইনডেক্সের তথ্যমতে, স্পট মার্কেট গত বছর ২২ ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল টনপ্রতি ৪০৭ দশমিক ৭৫ ডলার। তবে টানা কমতে থাকায় ২০ মার্চ এ দাম নামে ১৭১ দশমিক ৬০ ডলারে। এরপর স্পট মার্কেটে কয়লার দাম কিছুটা উঠানামা করলেও ২০০ ডলার ছাড়ায়নি। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ১৭৮ দশমিক ২০ ডলারে।
এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ইন্দোনেশিয়ার কয়লা। দেশটির সরবরাহকৃত সব ধরনের কয়লা দামও অনেক কমেছে। ইন্দোনেশিয়া কোল ইনডেক্স অনুযায়ী, পাঁচ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরির কয়লার দাম প্রতি টন ১১৫ দশমিক ৭৬ ডলার। এ মানের কয়লা ব্যবহার করা হয় রামপাল ও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আর ছয় হাজার ৮০০ কিলোক্যালরির কয়লার দাম প্রতি টন ১৭৩ দশমিক ৪৭ ডলার। এ কয়লা ব্যবহার করা হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তবে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায় এ কয়লা আমদানিতে ব্যয় পড়ে প্রতি টনে ১৪৫ ডলারের মতো।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে কয়লার দাম এতটা কমায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় অনেক কম পড়বে। পাঁচ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে আট টাকার মতো। তবে সে সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারণ ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
ডলার সংকটে কয়লা আমদানি বন্ধ থাকায় গত ২৩ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির। প্রায় দুই মাস ধরে এ কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে আছে। কয়লা কেনার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করতে পারেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড।
এদিকে পুরোনো আমদানি বিল পরিশোধ না করায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে চীনের সিএমসি। বর্তমানে কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক ১১ থেকে ১২ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন হয়। তবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার মজুত রয়েছে ১০ দিনের মতো। ফলে নতুন করে কয়লা না এলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম শেয়ার বিজকে জানান, আমদানির বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে
না। সবসময় ছয় মাসের বাকিতে কেনার চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পরেও পেমেন্ট করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ডলার সংকটের কারণে কয়লার বিল বাবদ গত ৯ মাসে কেন্দ্রটির বকেয়া জমেছে প্রায় ২৯৮ মিলিয়ন (২৯ দশমিক ৮০ কোটি) ডলার বা তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। বকেয়া পরিশোধ না করায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনকে (সিএমসি)।
দ্রুত ১০ কোটি ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ করা না গেলে সিএমসি আর পায়রার জন্য অতিরিক্ত টাকা দেবে না। আর সেটা না হলে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও কয়লা সরবরাহ করবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় এখনই কয়লা বিদ্যুতে বাড়তি সুবিধা নেয়া যেত। কিন্তু ডলার সংকটে কয়লা আমদানিই বন্ধ হয়ে গেছে। পিডিবি কয়লার দাম পরিশোধ করে দিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে তা পরিশোধ করতে পারছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে লোডশেডিং অস্বাভাবিক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।