নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পরিকল্পিত আটটি কয়লা প্রকল্প থেকে দূষণের ফলে ৩০ বছরে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া জাপান সরকারের অর্থায়নে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে নির্মিত কয়লা প্রকল্পের দূষণে আরও ১৪ হাজার মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আসন্ন কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে সংস্থাটির অবস্থান ও সুপারিশপত্র প্রকাশের জন্য গতকাল দুপুরে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান টিআইবির ক্লাইমেট ফাইন্যান্স পলিসি ইন্টিগ্রিটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মাহফুজুল হক। টিআইবি জানিয়েছে, রামপাল, মাতারবাড়ী, বাঁশখালীসহ বাংলাদেশে মোট ১৯টি বড় কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এতে উপকূলীয় জেলাগুলোয় দেড় লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা আরও হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
৩১ অক্টোবর থেকে গ্লাসগোতে শুরু হতে যাওয়া কপ-২৬ সম্মেলনকে প্যারিস চুক্তিপরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ছয় বছর আগে প্রাক-শিল্পায়ন সময় থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ১৯৬টি দেশ প্যারিস চুক্তিতে সম্মত হয়। এরই মধ্যে তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগ থেকে এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রতিবছর ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা থাকলেও তারা দিচ্ছে না। এর জের ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার বাংলাদেশও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। টিআইবি বলছে, প্যারিস চুক্তি-পরবর্তী সময়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য এ সম্মেলনই শেষ সুযোগ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলো কীভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসে যাবে, সেজন্য পদক্ষেপ নেবে। এটি করতে অনেকে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে থাকা দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা রয়েছে। সেই অর্থ যথাযথভাবে ছাড় করার উদ্যোগ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার, প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য মোট ১৪টি দাবি তুলে ধরেছে টিআইবি। দাবিগুলোর মধ্যে কপ-২৬ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ যেসব প্রস্তাব তুলে ধরতে পারে, সে বিষয়ে মোট আটটি দাবির কথা জানিয়েছে টিআইবি। সেগুলো হলো, জলবায়ুবিষয়ক নীতিনির্ধারণে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী কোম্পানিগুলোর অনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনসহ (আইএনডিসি) প্রশমনবিষয়ক সব কার্যক্রমে উন্নত দেশগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে শতভাগ জ্বালানি উৎপাদনে উন্নত দেশগুলোকে পর্যাপ্ত জলবায়ু তহবিল, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও কারিগরি সহায়তাদানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) পক্ষ থেকে সমন্বিত দাবি তুলতে হবে।
আটটি দাবির মধ্যে আরও রয়েছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে উন্নত দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল করতে হবে। জিসিএফসহ জলবায়ু তহবিলে ঋণ নয়, অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা অনুদান হিসেবে দিতে হবে। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি আলাদা তহবিল গঠন করতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ এবং এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রস্তুতিতে একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে এবং ঝুঁকি বিনিময়ে বিমার পরিবর্তে অনুদানভিত্তিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করে জিসিএফ থেকে যথাসময়ে ও দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্প অনুমোদন দিতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশও কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে টিআইবি। তারা বলছে, বাংলাদেশ ১০টি কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন কয়লা প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দেয়নি। অপর দিকে ১৯টি কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ৬৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করবে। এতে এশিয়ার অন্যতম কয়লাদূষণকারী দেশে বাংলাদেশের রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কপ-২৬ সম্মেলন সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকারের কী করণীয়, সে বিষয়ে আরও ছয়টি দাবি তুলে ধরেছে টিআইবি। সেগুলো হলো, ২০২১ সালের পরে নতুন কোনো ধরনের কয়লা জ্বালানিনির্ভর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থায়ন না করার ঘোষণা দিতে হবে। নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কপ-২৬ সম্মেলনে একটি আইনি সমঝোতা করতে সিভিএফের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। জীবন-জীবিকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত পরিবেশের প্রভাব নিরূপণ করে অগ্রসর হতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখাসহ প্রস্তাবিত ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যানে (আইইপিএমপি) কৌশলগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জ্বালানি খাতের স্বার্থের দ্বন্দ্বে সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক উপায়ে প্রস্তাবিত আইইপিএমপি প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করে প্রশমনবিষয়ক কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।