সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে। এর সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ সময়ে সংস্থাটি প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে ৩২ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি লিটারের আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮ টাকা। অথচ পূর্বনির্ধারিত দামেই বিক্রি হচ্ছে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলের দাম। এতে লিটারপ্রতি কয়েকগুণ মুনাফা করছে বিপিসি।
অপরদিকে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের জনগণ ও উদ্যোক্তারা। যদিও গ্রাহক পর্যায়ে তেলের দাম কমানোর পরিকল্পনাও নেই সরকারের, অথচ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কমিয়েছে তেলের দাম।
জানা যায়, গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এবং রাশিয়া-সৌদি আরবের মূল্যযুদ্ধÑএ দুইয়ের প্রভাব পড়েছে পণ্যটির দামে। ১৯৯১ সালের পর আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের সাপ্তাহিক গড় দামে সবচেয়ে বড় পতন দেখা গেছে। একইভাবে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের সাপ্তাহিক গড় দাম ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বেশি কমেছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবর রয়টার্স ও সিএনবিসি’র খবরের প্রকাশিত হয়।
অপরদিকে ব্লুমবার্গের জ্বালানি তেলের সর্বশেষ বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের গড় দাম দাঁড়িয়েছে ৩৯ ডলার, যা ১৯৯১ সালের জানুয়ারির পর সাপ্তাহিক গড় দামে সর্বোচ্চ পতন। একই চিত্র দেখা গেছে ডব্লিউটিআইয়ের দামেও। প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআইয়ের গড় দাম দাঁড়িয়েছে ৩৬ ডলার। আগের সপ্তাহের তুলনায় এ সময় জ্বালানি পণ্যটির গড় দাম কমে গেছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর এটাই জ্বালানি পণ্যটির সাপ্তাহিক দামে সবচেয়ে বড় পতন। এর সুফল বিশ্বের অধিকাংশ দেশের নাগরিকরা ভোগ করলেও বাংলাদেশের জনগণ সুবিধা নিতে পারছে না। কারণ এর প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশের জ্বালানি বাজারে। উল্টো অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে দেশে জ্বালানি তেলের আমদানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিপিসি। সংস্থাটি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামে তেল বিক্রি করছে। এভাবে সংস্থাটি বিপুল পরিমাণে মুনাফা করছে।
বিপিসি’র অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতে বিপিসি’র আমদানিকৃত প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৭০ ডলার। অর্থাৎ প্রতি লিটারের ক্রয়মূল্য ছিল ৩৭ টাকা। এরপর ব্যারেলপ্রতি ৬০, ৫০, ৪০, ৩৮ ডলারের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। আর সর্বশেষ ব্যারেলপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিল ৩২ ডলার। অর্থাৎ ১৭ টাকা ১০ পয়সা লিটারপ্রতি মূল্য পড়ে। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটির প্রথম দিকে জ্বালানি তেল রাখার সক্ষমতা পুরোপুরি পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে বিপিসিও সর্বনি¤œ দামে কেনার তেমন সুযোগ নিতে পারেনি।
সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৬ সালে দেশে দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। এরপর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেশি ছিল। এমনকি মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছিল। তখন বিপিসির লোকসান হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে বিপিসির পক্ষ থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এটি নিয়ে তখন বেশ আলোচনা হয়। পরে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
তারা আরও বলেন, আমাদের দেশে কোনো কিছুর দাম বাড়লে তা কমানো হয় না। উল্টো কিছু সময় পরপর বাড়তে থাকে। যেমন এখন গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। এখন সরকার যদি দাম কমিয়ে দেয়, তাহলে কি ভাড়া কমবে? এমন নজির দেশে নেই। আর বিপিসি নিজস্ব অর্থায়নে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং ডাবল লাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্প যখন গ্রহণ করা হয় তখন বিপিসি লোকসানে ছিল। এতে সরকারি টাকায় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। এখন বিপিসি নিজেই করছে। এছাড়া তেলের বাজার অস্থিতিশীল। পরিস্থিতি তো বোঝা যাচ্ছে না। এসব কারণে হয়তো দাম কমানো সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক, জনগণ আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য কমার সুযোগ পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসোইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আসলে দুঃখজনক। সরকারকে এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে হবে। অথচ এখনও পূর্বনির্ধারিত মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করছে সরকার। গত কয়েক মাস তো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার দিকে আছে। এতে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ দাম সমন্বয় করলেও আমাদের দেশে সমন্বয় হয়নি। এটা নিয়ে আমরা একবার জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংও করেছিলাম। তখন তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন। তবে তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে দেশের সাধারণ জনগণ সুফল পাচ্ছে না। শুধু বিপিসি কয়েকগুণ মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে। এ করোনা পরিস্থিতির কারণে উল্টো গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু তেলের দাম কমালে তো সব শ্রেণির গ্রাহক সুবিধা পেত। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও সুবিবেচনা করতে হবে।’
জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ মেহদী হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু আমাদের মজুত রাখার সক্ষমতা কম থাকায় আমরা তেমন এ সুবিধা নিতে পারছি না। তবে আমরা প্রথম দিকে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের কিনলেও পরে আস্তে আস্তে ৬০, ৫০, ৪৫ এবং সর্বশেষ ৩২ ডলারেও কিনেছি। কিন্তু আমাদের মজুত করার সক্ষমতা কম থাকায় আমরাও সুযোগ তেমন নিতে পারছি না। এখন তো লকডাউন নেই। সবকিছু সচল হয়েছে। কিছুটা সুযোগ পাওয়া যাবে। আর জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। সুতরাং আমাদের দাম না কমানো কিংবা বাড়ানোর সুযোগ নাই। কিন্তু বছর দুয়েক আগে তো বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে অভ্যন্তরীণ বাজারের দাম নির্ধারণে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিল। তবে তা আর হয়নি।’
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদা পূরণে এককভাবে ভূমিকা পালন করছে বিপিসি। দেশের কৃষি উৎপাদন, শিল্প প্রক্রিয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, গৃহস্থলীর কাজ ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিপিসির মোট জ্বালানি পণ্যের বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯৭ মেট্রিক টন। তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬৯ লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন।