কয়েক ঘণ্টার কারসাজিতেই শেয়ারদর ওঠে ২ হাজার টাকায়

আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্ল্যাটফর্মে (এসএমই প্ল্যাটফর্ম) চলতি বছরের ২৮ জুলাই থেকে লেনদেন শুরু করে ওটিসি ফেরত কোম্পানি ‘ইউসুফ ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড’। কোম্পানিটি গত ১৩ নভেম্বর  শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এতে ওইদিন কোম্পানিটির শেয়ারে দর বৃদ্ধি বা কমার ক্ষেত্রে কোনো প্রান্তসীমা বা সার্কিট ব্রেকার না থাকার কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার লেনদেনে শেয়ারটির দর ২ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠানো হয়।  ফলে শেয়ারের দর আগের কার্যদিবসে সর্বশেষ লেনদেন হওয়া দামের থেকে ৭ হাজার ৫৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে সেদিন লেনদেন শেষে শেয়ারটির দর কমে ৫৯৪ টাকায় এসে দাঁড়ায়; যা একেবারেই অস্বাভাবিক।

বিষয়টি কারসাজির কারণে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। কারণ একই দিনে শেয়ারের দর সাড়ে ৭ হাজার শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়া সহজ বিষয় নয়, যা সম্ভব হয়েছে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন অনেক কম। কোম্পানিটির শেয়ারসংখ্যা মাত্র ৬ লাখ ৬ হাজার, আর এর শেয়ারদর সেদিন কয়েক ঘণ্টার কারসাজির কারণে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্যের বিপরীতে ৫৭ গুণের বেশি বেড়ে যায় এবং দিনশেষে ১৭ গুণ বেশি দাঁড়ায়। তাই এ ধরনের সহজে কারসাজি করা যায় এমন কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো ছাড়াও প্রতিনিয়ত নজরদারি করা এবং কারসাজিকারীদের কঠিন শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানানো হয়।

কোম্পানির শেয়ার ও লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, ওটিসি মার্কেট থেকে আসার পর এসএমই প্ল্যাটফর্মে কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ২৩ টাকা ৮০ পয়সায়। এরপর গত আগস্ট মাসে শেয়ারটির দর কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ টাকা ১০ পয়সা এবং ১০ নভেম্বর পর্যন্ত একই দরে অবস্থান করে শেয়ারটির দর। কিন্তু যেদিন লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয় অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর, সেদিন দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো সার্কিট ব্রেকার না থাকায় দিনশেষে এক লাফে শেয়ারটির দর দাঁড়ায় ৫৯৪ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু ওইদিন লেনদেন চলাকালে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দেখা যায় শেয়ারটি সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকায় পৌঁছে; যা গত ৫২ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ দর।

এদিকে লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, কোম্পানিটির লেনদেন শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানির একটি শেয়ার লেনদেন হয়। পরে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির আর কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। এরপর লভ্যাংশ ঘোষণার দিন আবার কোম্পানির ৯টি শেয়ার লেনদেন হয়, যা এ পর্যন্ত কোম্পানির সর্বোচ্চ লেনদেন এবং এ লেনদেনের মাঝেই এর দর ২ হাজার টাকায় নেয়া হয়। পরে ১৩ নভেম্বরের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কোম্পানির আর কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। ফলে শেয়ারটির দর ১৩ নভেম্বরে শেষ হওয়ার দরেই গতকাল পর্যন্ত অবস্থান করছে। 

অপরদিকে কোম্পানিটি সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য নগদ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৫ টাকা ৫৩ পয়সা এবং ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা ৫৬ পয়সায়।  কোম্পানিটির এজিএম হবে ২৮ ডিসেম্বর এবং কোম্পানির রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ আর্থিক হিসাব অনুযায়ী কোম্পানির এনএভি ৩৫ টাকা। কিন্তু এর শেয়ার এখন পর্যন্ত ৫৯৪ টাকায় রয়েছে, যা পুরোটাই কারসাজির মাধ্যমে করা হয়েছে। কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেট থেকে এসএমই প্ল্যাটফর্মে এসেছে। সে ক্ষেত্রে সবারই জানা আছে, একটি কোম্পানি কেন ওটিসি মার্কেটে থাকে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ব্যবসা ভালো অবস্থানে। কিন্তু আসলেই কি কোম্পানিটি ভালো ব্যবসা করেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোঁজ নিয়েছে? এমন প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, কোম্পানি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার নতুন করে যদি ব্যবসা শুরু করেও থাকে, তবুও তো এত ভালো ব্যবসা হবে না যে এর শেয়ার ২ হাজার টাকা হতে পারে।

এদিকে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনই মাত্র ২ কোটি টাকা, আর শেয়ার সংখ্যা ৬ লাখের কিছুটা বেশি। সে হিসাবে কোম্পানি যা মুনাফা করবে, সেটা এই অল্প শেয়ারে ভাগ হওয়ায় বেশিই দেখাবে। ফলে গত বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় ৫ টাকার বেশি দেখানো হয়েছে। তাই বলে এর শেয়ারদর ২৬ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা হতে পারে না। যেখানে মাত্র ৬ লাখ শেয়ারের বিপরীতে এর এনএভি ৩৫ টাকা, সে হিসাবে সম্পদ খুব বেশি নয়। যদি পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হয়, তবে এনএভি আরও অনেক কমে যাবে।

তারা আরও বলেন, সার্কিট ব্রেকার না থাকায় কারসাজিকারী এ সুযোগ নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে খুব বেশি শেয়ার ক্রয় করতে হয়নি। মাত্র ৯টি শেয়ার কিনেই শেয়ারের দর ৫৯৪ টাকায় রেখে দিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো পদক্ষেপ নেই। এর সঙ্গে কোম্পানির কোনো যোগসাজশ রয়েছে কিনা। একটি বন্ধ থাকা কোম্পানি ব্যবসা শুরু করেই ইপিএস ৫ টাকা মুনাফা করে। আর সম্পদও বেড়ে যায়। সে বিষয়েও নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত করা উচিত এবং যাদের কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত পাওয়া যাবে, তারা যেই হোক না কেন তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, ইউসুফ ফ্লাওয়ারের শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিষয়টি কোনো আইনের পরিপন্থি কিনা তা আমার জানা নেই। তাই কিছু বলতে পারছি না। এ বিষয়ে বিএসইসির ‘ল’ বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পর বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ইউসুফ ফ্লাওয়ারের অনুমোদিত মূলধন ২ কোটি টাকা। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এতে কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা ৬ লাখ ৬৮ হাজার। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৫৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ, সরকারের রয়েছে দশমিক ৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০