Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:46 pm

করছাড় দিয়ে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার উদ্যোগ

রহমত রহমান: বহুজাতিক ও দেশীয় বৃহৎ বিভিন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে শক্তিশালী অবস্থানে যাবে দেশের পুঁজিবাজার। তবে এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে করহারে উল্লেখযগ্য ছাড় নেই। এজন্য বহুজাতিক ও দেশীয় বৃহৎ কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে আগ্রহ দেখায় না। তাই করছাড় দেয়া হলে এ ধরনের কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসবে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে করহার কমানোসহ আটটি সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ১৩ এপ্রিল বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য পুঁজিবাজারের উন্নয়নে’ আটটি সুপারিশ করে এই চিঠি দেয়া হয়। সুপারিশগুলোর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে তা বিবেচনার জন্য অর্থমন্ত্রী ২৮ এপ্রিল এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান।

চিঠিতে বলা হয়, পুঁজিবাজার হবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মূল উৎস এই লক্ষ্যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন জরুরি। চিঠিতে প্রথমে পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা আইপিও এর মাধ্যমে সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার কমানোর সুপারিশ করা হয়। বর্তমানে পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার সাড়ে ২২ শতাংশ রয়েছে। এক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে করহার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করহার ১৫ শতাংশ, পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ২০ শতাংশ শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করহার সাড়ে ১৭ শতাংশ এবং পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করহার ২০ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি যেমন ইউনিলিভার, নেসলে, শেভরন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংকএনএ, সনি, কোকাকোলা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত স্থানীয় ব্যবসায় গ্রুপ যেমন আবুল খায়ের, মেঘনা গ্রুপ, প্রাণ আরএফএল, আকিজ, বসুন্ধরা, যমুনা, সিটি, আবদুল মোনেম ইত্যাদি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন লাভজনক ও সুশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার লিস্টিং-এ উৎসাহিত করতে করহার সাড়ে ২২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় সুপারিশে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনিয়োগের শর্ত আরও শিথিল করার সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, অপ্রদর্শিত আয় ৫ শতাংশ কর প্রদান করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আরও ৫ বছর সুযোগ দেয়া হলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। অন্যথায় অপ্রদর্শিত অর্থ অপব্যবহার বা বিদেশে পাচারের সুযোগ থেকে যাবে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে গত দুই অর্থবছর বিনাপ্রশ্নে বিনিয়োগের সুবিধা দিয়েছে সরকার। তবে প্রথম বছর কিছুটা সাড়া থাকলেও চলতি বছর তেমন সাড়া দেয়নি বিনিয়োগকারীরা।

দ্বৈত করনীতির বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, করপোরেট কর কর্তনের পর লভ্যাংশ প্রদান করা হয়। লভ্যাংশ প্রদানের সময় যাদের ই-টিআইএন আছে, তাদের ১০ শতাংশ এবং যাদের ই-টিআইএন নেই তাদের ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর কর্তন করা হয়। পরবর্তীতে আবার লভ্যাংশ গ্রহীতার ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্নের সময় তার ওপর প্রযোজ্য হারে কর প্রদান করতে হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, বড় বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ গ্রহণ না করে রেকর্ড ডেটের আগেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়, যা বাজারকে অস্থির করে। এটি দ্বৈত করনীতির আওতায় পড়ে। এক্ষেত্রে লভ্যাংশের ওপর কর প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহী হবে, যা পুঁজিবাজার উন্নয়নে সহায়ক হবে।

করমুক্ত সীমা এক লাখ টাকা করার সুপারিশ করে বলা হয়, আয়কর আইনে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও ইউনিট ফান্ড থেকে অর্জিত আয় ৫০ হাজার এবং ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই করমুক্ত সীমা বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করার অনুরোধ করা হয়। মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করহার ১০ শতাংশ কমানোর সুপারিশ করে বলা হয়, মার্চেন্ট ব্যাংকের বর্তমানে করপোরেট করহার সাড়ে ৩৭ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিদ্যমান ব্যাংকিং কোম্পানিজ আইন অনুযায়ী গঠিত কোনো ব্যাংক নয়। বরং সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী গঠিত বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। সুতরাং তফসিলি ব্যাংকগুলোর মতো একই হারে তাদের ওপর করারোপ করা হলে তাদের টিকে থাকা এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভবপর হবে না। সেজন্য মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট কর ১০ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়।

আরও বলা হয়, জিরো কুপন বন্ডের জন্য প্রযোজ্য কর সুবিধা সব ধরনের বন্ডের এবং সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর (ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক) জন্য করা যেতে পারে। এতে বন্ড জনপ্রিয় ও রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করতে এসএমআই কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে প্রথম ৩ বছর শূন্য, পরবর্তী বছর ১৫ শতাংশ রেয়াতি হারে কর নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। পুঁজিবাজারে বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়, দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিতান্তই কম। অথচ পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বিদেশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের করহার ২০ ও ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ ও ২০ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়। এতে তারা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।

আরও বলা হয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি যাদের এক বা একাধিক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে, সেসব কোম্পানির পুঞ্জীভূত আয় বা তহবিল, রিজার্ভ এবং কর-পরবর্তী নিট আয় সেসব কোম্পানির কনসোলিডেটেড আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে গণনা বা নির্ধরাণ করার সুপারিশ করা হয়। কারণ কনসোলিডেটেড আর্থিক বিবরণীর নিট মুনাফার ভিত্তিতেই লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, দেশের পুঁজিবাজার মূলত ইক্যুইটি নির্ভর বাজার। বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারের পণ্য বৈচিত্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজার উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পুঁজিবাজার উন্নত হলে অর্থায়নের জন্য বিদ্যমান ব্যাংক-নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত শিল্পায়নে ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া পুঁজিবাজারের লেনদেন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।