শেখ আবু তালেব: দেশের ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতের সাইবার হামলা মোকাবিলায় উচ্চ পর্যায়ের আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইটি ও সাইবার বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখা হচ্ছে। সাইবার হামলা-সংক্রান্ত ইস্যু ও ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকে সুপারিশ দেবে এ কমিটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতে সাইবার হামলা আলোচিত বিষয়। মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রীয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাইবার হামলা-সংক্রান্ত ইস্যুতে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এ নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রায়ই সাংঘর্ষিক তথ্য সামনে উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের আইটি কর্মীদের মাঝেও প্রশ্ন ওঠে। আদৌ ব্যাংক খাতে সাইবার হামলার ঘটনাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় রাষ্ট্রীয় দুই প্রতিষ্ঠানের ভিন্নমত ব্যাংকারদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জš§ দিচ্ছে বলে আলোচনায় উঠে আসে। এজন্য গভর্নরের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করার। কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সাইবার বিশেষজ্ঞ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল এ কমিটির অনুমোদন দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আট সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ আহমেদ জামালকে। সদস্য হিসেবে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (প্রোগ্রাম) দেবদুলাল রায়, নির্বাহী পরিচালক (মেইনটেন্যান্স) মোহাম্মাদ জাকির হাসান। দুজনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি-সংক্রান্ত বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। আরও রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাহুল হক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের কর্মকর্তা। উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক পর্যায়ের প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধি ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি। শিগগির কমিটিতে সদস্য দিতে অন্য প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সাইবার হামলা পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ গভর্নমেন্টস ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপনস টিম। সংক্ষেপে যা সিআইআরটি বা সার্ট নামে পরিচিত। ১৬ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি দুটি সাইবার হামলার বিষয়ে অ্যালার্ট বা সতর্কতা জারি করে তারা। বিশেষ করে দুটি ম্যালওয়্যারের একটি ‘ক্যাসাব্লাংকা’ ঝুঁকির বিষয়টি উল্লেখ করে। এটি ব্যাংকগুলোয় হামলা করছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে ব্যাংকগুলোকেও সতর্ক করা হয়। সার্টের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, এ হামলার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পুলিশ, সরকারের করোনা-বিডি ওয়েবসাইট, ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও বিকাশসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাইবার হামলার মুখে পড়ার তথ্য এসেছে। হামলার পেছনে ‘ক্যাসাব্লাংকা’ নামের একটি হ্যাকার গ্রুপকে শনাক্ত করেছে সার্টের সাইবার থ্রেট গবেষণা দল। ১৫ ফেব্রুয়ারি এসব প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা হয়।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় সাইবার হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করেছিল সরকার। এছাড়া গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ওপর সাইবার হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়ায় তথ্যর আলোকেই সতর্কতা জারি করে ব্যাংকগুলোর জন্য প্রজ্ঞাপনও দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন পেয়ে অনেক ব্যাংক অনলাইন ব্যাংকিং সেবা সীমিত করেছিল। রাতে এটিএম সেবাও বন্ধ রাখে অধিকাংশ ব্যাংক। কিন্তু এ সময়ে হামলার কোনো ঘটনা ধরা পড়েনি। এ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আইটি বিভাগ ও দেশের সাইবার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রশ্ন উঠে দিনে কি হ্যাকাররা হামলা করবে না? তারা কি শুধু রাতে হামলা করবে? এ বিতর্কের অবসান হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের সাইবার সতর্কতা নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিপরীত মতো উঠে আসে। এক পক্ষ দাবি করেছে, ম্যালওয়্যারের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি ব্যাংক খাতে। অন্য পক্ষ দাবি করে হামলা ঠেকানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের ওপর সাইবার হামলার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে কমিটি গঠন করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সাইবার হামলার ঝুঁকি শনাক্তকরণ ও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় নির্ধারণ করতে সুপারিশ করবে কমিটি। নির্দিষ্ট কিছু তথ্য রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিনিময় করা হবে। যদিও আর্থিক খাতের আইটি-সংক্রান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক একটি সেল রয়েছে।