করপোরেটদের আগ্রাসী বিনিয়োগে আতঙ্কিত ছয় ব্যাংক

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ নিয়াজ মাহমুদ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে আধিপত্য বিস্তার করেছে এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটি বাজার থেকে শেয়ার কিনে সফলতার সঙ্গে পর্ষদে ঢুকেছে। একই কৌশল অবলম্বন করে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) নিয়ন্ত্রণ চায় গ্রুপটি। সম্প্রতি ব্যাংকটির বড় অঙ্কের শেয়ার কিনে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এ অবস্থায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি শেয়ার থাকায় আতঙ্কিত ছয় ব্যাংকের পর্ষদ। এ তালিকায় রয়েছে এসআইবিএল, উত্তরা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এসআইবিএলের শেয়ার কিনে পরিচালনা পর্ষদে বসতে চেয়েছিল দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপও। সুবিধা করতে না পেরে প্রায় ৩১ শতাংশ শেয়ার কেনার পরও অন্য আরেকটি গ্রুপের কারণে শেষ পর্যন্ত নিজ অবস্থান থেকে সরে যায় ইউনাইটেড গ্রুপ।

জানা যায়, এসআইবিএলের পরিচালনা পর্ষদে ঢুকতে ব্যাংকটির ৩০ শতাংশ শেয়ার কিনেছে এস আলম গ্রুপ। গত ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপের শাহ আমানত প্রাকৃতিক গ্যাস, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন, মেরিন এমপায়ার লিমিটেড, সিঅ্যান্ডএ অ্যাকসেসরিস, সিঅ্যান্ডএ ফেব্রিকসসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ১৭ হাজার ৬৩০টি শেয়ার কিনেছে গ্রুপটি, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

এস আলম গ্রুপ ইতোমধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রায় এক ডজনের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আগ্রহ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর সঙ্গে। সম্প্রতি তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এখন ট্রেডিং ব্যবসায়ের চেয়ে ব্যাংক ব্যবসায় বেশি মনোযোগী। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকে আমাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগামীতে বিভিন্ন ব্যাংকে আমাদের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে। এজন্য শেয়ার কেনা হচ্ছে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যমতে, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে সবচেয়ে বেশি শেয়ার রয়েছে উত্তরা ব্যাংকের। বিনিয়োগকারীরা এ ব্যাংকের ৬০ দশমিক ৩৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন। পরের অবস্থানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৫৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। একইভাবে বিনিয়োগকারীদের কাছে এসআইবিএলের ৫২.৫৮ ও এনবিএলের ৪৭.৫৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। তালিকায় থাকা অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওয়ান ব্যাংকে বিনিয়োগকারীদের ৪৬.২০ শতাংশ ও পূবালী ব্যাংকের ৪৫.৭৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ শেয়ার থাকায় বড় করপোরেটদের নজরে রয়েছে ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের শেয়ারদর ১৬ টাকা থেকে ৩৪ টাকার মধ্যে থাকায় ৩০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মালিকানাসহ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে কথা হয় এসআইবিএলের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. মো. রেজাউল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। তা থাকলে বোর্ডই সব ক্ষমতার মালিক। এখানে বোর্ডের বাইরে কারও শেয়ার নিয়ে দাপট দেখানোর কিছু নেই। যদি কেউ এটা করতে চায়, তবে তা বোর্ডের মাধ্যমেই করতে হবে। তিনি বলেন, টাটা গ্রুপ মাত্র আট শতাংশ শেয়ার নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। এখানে অন্য কেউ কর্তৃত্ব দেখাতে পারছেন না।

বিষয়টিকে অনৈতিক ও পুঁজিবাজারের জন্য স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। আর ব্যাংকের উদ্যোক্তারা এটাকে পুঁজিবাজারের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, একটি প্রতিষ্ঠান তিল তিল করে গড়ে  তোলেন উদ্যোক্তারা। আর প্রতিষ্ঠানটি যখন উন্নতি করে, বাজার থেকে শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক হওয়া যাবে। কিন্তু ৫০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। বাজার থেকে শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দখল নেওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ভবিষ্যতে ইসলামী ব্যাংকের মতো আরও কোনো ঘটনা ঘটলে পুঁজিবাজারে কেউ তালিকাভুক্ত হতে চাইবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসিকে বিষয়টি আমলে নিতে হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা সুরক্ষায় গাইডলাইন থাকতে হবে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, উদ্যোক্তাদের সুরক্ষার জন্য বিএসইসির গাইডলাইন জরুরি। বিএসইসি যদি একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে দেয়, তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি বিএসইসির সঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে একটি উদ্যোক্তা সুরক্ষা গাইডলাইন বের হয়ে আসতে পারে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে কেউ হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ঢুকে পড়া পুঁজিবাজারের জন্য ভালো সংবাদ নয়। এতে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত হতে দ্বিধাদ্বাদ্ধে পড়বে। তবে আমি মনে করি, এটা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ যারা মূল স্পন্সর তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার থাকলে মালিকানা হারানোর ভয় নেই।

রাতারাতি ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের মালিক হয়ে যাওয়া এবং পরিচালনা পর্ষদে ঢোকা প্রতিষ্ঠানের জন্য  মোটেই সুখকর নয় বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে ব্যাংকের জন্য এটা খুবই খারাপ খবর। এতে আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে স্ট্যার্ডাড ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, হঠাৎ করে কেউ পরিচালনা পর্ষদে ঢুকে পড়লে প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থাকে। বিষয়টি অবশ্যই শঙ্কার। তবে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সাধারণ সভা ও বোর্ড মিটিংয়ে আগ্রহী ব্যক্তির পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন থাকতে হবে। আমাদের বোর্ডের প্রতি সেই আস্থা রয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই। হুট করে কোম্পানির শেয়ার কিনলে পর্ষদে ঢুকলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকের প্রতি আন্তরিকতা থাকে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কথা হয় পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, কেউ যদি শেয়ার কিনে পরিচালক হতে চান, তাকে আইনকানুন মেনেই আসতে হবে। তবে আমাদের ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ার যাদের হাতে, তারা বেশ পেশাদার ব্যবসায়ী। সুতরাং নিয়ম মেনে কেউ যদি পরিচালক হতে চান, তাকেও পেশাদার হতে হবে। তা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন শেয়ারহোল্ডারদের (যিনি পরিচালক হতে আগ্রহী) তাকে বয়কট করা হতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক।

জানা যায়, করপোরেটদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ফলে এসব ব্যাংকের দিকে তাদের নজর বেশি। যে কারণে তারা এসব ব্যাংকের মালিকানা পেতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা শেয়ার বিজকে বলেন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হওয়ার কারণে শেয়ার ক্রয় করেছিলাম। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হয়ে ব্যাংকটিকে আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহযোগী না পাওয়ার কারণে হাতে থাকা শেয়ার এখন বিক্রি করছি।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি এককভাবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শেয়ার কিনতে চান, তাহলে বিএসইসির অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

অন্যদিকে করপোরেটদের প্রতিষ্ঠান দখলের প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ কোনো শেয়ারের দর যখন বাড়তে থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকে পড়েন তারা। ফলে বেশি দরে শেয়ার কিনে নিতে আগ্রহী হোন। কারণ বাজারে তখন এসব শেয়ার নিয়ে নানা গুজব ঘুরে বেড়ায়। যে কারণে কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না তারা। শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেলে তারাই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, তালিকাভুক্ত যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের অস্বাভাবিক লেনদেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা না বুঝে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। আর সুযোগসন্ধানীরা তাদের কাছে বেশি দরে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়ে চলে যায়। ফলে শেষ ধাক্কাটি বিনিয়োগকারীদেরই সামলাতে হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০