করপোরেট করহার কমানোর সুবিধা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:বিগত অর্থবছরে কিছু শর্ত সাপেক্ষে প্রায় সব ক্ষেত্রে করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় হ্রাসকৃত কোম্পানি করহার সুবিধা কেউই ভোগ করতে পারছেন না বলে মনে করে ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রপলিট্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই)। সুবিধা পাওয়ার জন্য শর্তগুলো বাতিল করার প্রস্তাব করেছে এমসিসিআই। গতকাল বুধবার এনবিআর সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এমসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব করা হয়। এতে এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন।

সভাপতি বলেন, সামগ্রিক জাতীয় রাজস্বের প্রায় ৪০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি আসে এমসিসিআইয়ের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। দেশের বড় প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গ্রুপ যারা প্রতিবছরই সর্বাধিক পরিমাণ জাতীয় রাজস্ব দিয়ে থাকে, যেমনÑব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো, গ্রামীণফোন, স্কয়ার গ্রুপ, এসিআই গ্রুপ, বেক্সিমকো, ট্রান্সকম গ্রুপসহ অন্যরাও এমসিসিআইয়ের সদস্য। সেই হিসেবে এমসিসিআই ও এর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এমসিসিআই সবসময় একটি উন্নত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালুকরণে গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কর আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩৮ দশমিক ৫২ শতাংশ কর আহরণ করা হয়েছে।

সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘অর্থ আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী নগদ লেনদেনের শর্তাবলির প্রযোজ্যতার কারণে হ্রাসকৃত করহার সুবিধা নেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশের অধিক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি। এই অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির মাধ্যমেই দেশের শিল্প ব্যবস্থা ক্রমেই অগ্রসরমাণ। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় করহারের ক্ষেত্রে ‘অর্থ আইন, ২০২৩’-এর শর্তাবলি বাতিল বিবেচনায় বিষয়টিতে এনবিআরের দৃষ্টি প্রয়োজন বলে মনে করে এমসিসিআই।

আরও বলা হয়, দেশে কার্যকর করপোরেট করহার অনেক বেশি। এখানে অননুমোদিত ব্যয় এবং উৎসে কর কর্তন এত বেশি যে, ব্যবসায়ীরা এই করপোরেট করহারের কমানোর সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। বাস্তবে এই করপোরেট করহার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ আর থাকে না, তা ক্ষেত্র বিশেষে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যায়। বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

অনলাইনভিত্তিক আয়কর রিটার্ন যাচাইকরণ ব্যবস্থা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার বলে উল্লেখ করে সভাপতি বলেন, এক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদান নথি নং ও তারিখ অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এই ব্যবস্থা আরও ফলপ্রসূ হবে। এছাড়া ‘অনলাইনভিত্তিক ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন জমাদান’ পদ্ধতি আরও একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে করদাতারা সব ধরনের দলিলাদি অনলাইনের মাধ্যমে সংযুক্তির সুবিধা পেলে এই অনলাইনভিত্তিক আয়কর রিটার্ন জমাদান পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয় হবে বলে এমসিসিআই বিশ্বাস করে।

সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় সব কোম্পানিগুলো মাসিক ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে থাকে। তবে এই ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে অটোমেশন নয়। ই-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই অটোমেশন ব্যবস্থা গতিশীল হবে বলে এমসিসিআই মনে করে। এছাড়া ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব উপাদানকেই পণ্য বা সেবার উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করে আইনের ধারা পরিবর্তন সাপেক্ষে রেয়াত ব্যবস্থার অটোমেশন পূর্ণাঙ্গরূপে গতিশীল হবে।

আরও বলা হয়, নতুন আয়কর আইনের ২৬৪ ধারা অনুযায়ী ৪৩টি ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণপত্র (পিএসআর) দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্যাপক সংখ্যক পিএসআর দাখিলের বিধান ব্যবসার সক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে ব্যাহত করছে। পিএসআর সংগ্রহকারীর পক্ষে হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা জটিল হচ্ছে। কোম্পানিগুলো এনবিআরের পক্ষে আইনসিদ্ধভাবে কর ব্যবস্থাপনা তদারকি করে থাকে। তবে আয়কর আইন-বহির্ভূতভাবে অনেক সময় পিএসআরের তথ্যাবলি ছাড়াও করদাতাদের আয়ের বিবরণ, কর দেয়ার পরিমাণ-সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্যাবলি সংগ্রহ করা যৌক্তিকও নয়। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা থাকা সত্ত্বেও হালনাগাদকৃত পিএসআর দাখিলের বিধান সাংঘর্ষিক ও বাস্তবসম্মত নয় বলে দেখা যাচ্ছে। ফলে এই বিধানের ক্ষেত্রগুলো বাস্তবসম্মতভাবে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

ছয় বছরের বেশি সময় পর্যন্ত পরিসম্পদ কর বিবেচনা করার বিষয়ে বলা হয়, নতুন আয়কর আইনে ছয় বছরের অধিককাল পর্যন্ত পরিসম্পদ বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। বাস্তব অবস্থায় ছয় বছরের আগের বছরগুলোর হিসাব অনেকাংশে সংরক্ষণ করা খুবই দুরূহ। ছয় বছরের অধিককালের কোনোরূপ সীমারেখা না রেখে প্রণীত আইন দেশের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

অনুমোদিত ফান্ডগুলোর ওপর করারোপ বিষয়ে বলা হয়, ‘অর্থ আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্য তহবিল, অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিল, অনুমোদিত আনুতোষিক তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ওপর করারোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এই ফান্ডের জন্য কোনোরূপ কর আরোপের বিধান নেই। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সীমারেখা আইনগতভাবে দৃষ্টিকটু। ফান্ডগুলোর করারোপ থেকে বিরত থাকতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায় এমসিসিআই।

স্থানীয় শিল্প সম্প্রসারণে রাজস্ব সুবিধা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ৪০ লাখ জনশক্তি রয়েছে, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬০ বছর, যারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত নয় (নিট)। এই বৃহৎ জনশক্তিকে শ্রমবাজারে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। এই বৃহৎ জনশক্তিকে যদি দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে আমাদের জিডিপির ওপর অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় শিল্পের বিকাশ খুবই জরুরি। স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা স্থানীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আয়কর হার, মূসক ব্যবস্থাপনা, শিল্প যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্কহার, সম্পূরক শুল্কহার যথাযথভাবে বিবেচনা করে স্থানীয় শিল্প সম্প্রসারণে এনবিআর দৃষ্টি দেবে বলে বিশ্বাস করে এমসিসিআই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০