নিজস্ব প্রতিবেদক: শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে কর প্রদান ও কর আদায় বাড়াতে করপোরেট করে ছাড় দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে জড়িত কোম্পানির কর আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ হারে কমতে পারে। তবে বাকি সব খাতে করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকতে পারে। মূলত কোম্পানিগুলোকে ছাড় দিয়ে বেশি কর আদায় করার মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী করপোরেট কর কমানোর বিষয়ে সায় দিয়েছেন। আবার করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানো, মানুষের কষ্ট লাগবে ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে করছাড় অব্যাহত রাখা, ডিজিটাল ২৭টি সেবায় করছাড় আরও দু’এক বছর অব্যাহত রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সায় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী।
গতকাল রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। এই বৈঠকে আগামী বাজেটে যেসব পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান উপস্থিত ছিলেন। কর্মকর্তারা বাজেটের যেসব পরিবর্তনের বিষয় উল্লেখ করেছেন, তার বেশিরভাগের সঙ্গে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী একমত হয়েছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করপোরেট কর কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সব খাতে নয়, কেবল উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারের তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি এ ছাড়ের সুবিধা পাবে। বর্তমানে এসব কোম্পানির করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ। শর্তসাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কমে ২৫ শতাংশ হতে পারে। কোম্পানিকে কর প্রদানে উৎসাহ দেয়া, কর প্রদানে স্বচ্ছতা বাড়াতে এই করহার কমানো হবে। তবে অন্যান্য করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকবে। সর্বশেষ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেট কর ছিল ৩৫ শতাংশ। তা থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা পেতে দুটি শর্ত মানতে হয়। প্রথমত, সব ধরনের আয় ও প্রাপ্তি এবং ৫ লাখ টাকার বেশি একক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বছরে ৩৬ লাখ টাকার বেশি ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ কোম্পানির কর ৩০ শতাংশ। তবে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। কারণ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে অনেক করদাতা করজাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, গত কয়েক অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু শর্তের কারণে ব্যবসায়ীদের অনেকে কমানো করহারের পুরো সুবিধা নিতে পারছেন না। সে জন্য শর্ত পরিহার করে কার্যকর করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্রমতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ছেড়েছে, সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২০ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানি আইপিওতে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে, তাদের ক্ষেত্রে করপোরেট করহার সাড়ে ২২ শতাংশ। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়Ñএমন কোম্পানির করপোরেট করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ। একক ব্যক্তির কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করহার নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ২২ শতাংশ। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে বর্তমানে করপোরেট করহার নির্ধারিত রয়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। যেসব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, তাদের ক্ষেত্রে করপোরেট কর ৪০ শতাংশ। এর বাইরে তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করপোরেট কর ৪০ শতাংশ। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর নির্ধারিত রয়েছেÑসিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে, এ হার ৪৫ শতাংশ। এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে করপোরেট করের পাশাপাশি আড়াই শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হয়।
একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলারের দাম বাড়ছে। ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানি ও তা দিয়ে তৈরি পণ্যের খরচ বাড়বে। এতে মানুষের ওপর ছাপ বাড়বে। সে জন্য ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে যথাসম্ভব করছাড় দেয়ার পক্ষে সায় দিয়েছেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। ২৭টি ডিজিটাল সেবায় কর অব্যাহতির মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে। ফলে এ খাতে অব্যাহতি তুলে দিতে পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে সরকার প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে এসব সেবায় অব্যাহতি আরও দু’এক বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। এর আগে অব্যাহতি অব্যাহত রাখতে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছেন। স্থানীয় শিল্পে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চায় সরকার। সেজন্য স্থানীয় শিল্পের প্রসারে যেসব খাতে কর অব্যাহতি ও ছাড় রয়েছে; তা অব্যাহত রাখতেও সায় দেয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালে দেশের পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। এরপর থেকে বিনিয়োগকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে বাজারমুখী করা এবং নতুন প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনতে কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা সীমিত ছিল। ২০১৫ সাল থেকে কর সুবিধা আরও বাড়ানো হয়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ ধসের পর থেকে হিসাব করলে ১৪ বছর, আর ২০১৫ থেকে হিসাব করলে ৯ বছর এই সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর সুবিধা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভোগ করতে পারেন না। মূলত বাজার অস্থিতিশীল বা বাজারে ধস নামার সঙ্গে জড়িত ফটকা বিনিয়োগকারীরা। সেজন্য আগামী বাজেটে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা কোথাও কোথাও কমিয়ে আনা, আবার কোথাও কোথাও তুলে নেয়া হতে পারে। পুঁজিবাজার থেকে করছাড় কমিয়ে আনতে আইএমএফ ইতোমধ্যে এনবিআরকে পরামর্শ দিয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। তবে কর আদায় বাড়াতে ধনীদের ওপর করহার বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় রয়েছে, এমন করদাতাদের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। এছাড়া করদাতাদের হয়রানি কমাতে সব শ্রেণির করদাতাদের স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা কমানো হতে পারে। বেশ কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক তুলে নেয়া হতে পারে।