Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:42 am

করমুক্ত আয়ের পরিমাণ সর্বনিম্ন চার লাখ করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: করমুক্ত আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বনিম্ন চার লাখ করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এরই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা, শিল্পায়ন ও পুঁজি বাজার উন্নয়ন, গার্মেন্ট সেক্টরে বিশেষ সুবিধা প্রদান, পরিবহন ও বিমান শিল্পে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবনা রাখা হয় এ প্রস্তাবনা পত্রে।

আসন্ন জাতীয় বাজেটে চলমান মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে নাগরিকের করমুক্ত আয়ের পরিমাণ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন চার লাখ করার প্রস্তাবনা দিয়েছে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)।

এরই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা, শিল্পায়ন ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন, গার্মেন্ট সেক্টরে বিশেষ সুবিধা প্রদান, পরিবহন ও বিমানশিল্পে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবনা রাখা হয় এ প্রস্তাবনা পত্রে।

আইসিএমএবি আয়োজিত জাতীয় বাজেট পূর্ববর্তী বিশ্লেষণের ভার্চুয়াল সেমিনারে (ওয়েব সেমিনার) এমন মতামত রেখেছেন দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক এবং ব্যক্তিত্বরা। গত শুক্রবার এ সেমিনার আয়োজিত হয়।

আইসিএমএবি মনে করে, টিকে থাকাটাই এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সামাজিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী করে তোলার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করাই বাজেটের লক্ষ্য হয়ে ওঠা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী এবং এনবিআর সদস্য (ট্যাক্স সার্ভে অ্যান্ড ইনস্পেকশন) রঞ্জন কুমার ভৌমিক মূল আলোচক ছিলেন।

আইসিএমএবি প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন আকন্দ অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন। আইসিএমএবি ভাইস প্রেসিডেন্ট মামুনুর রশীদ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জাতীয় বাজেট ২০২০-২১ এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবনা-সম্পৃক্ত একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এছাড়া এতে অংশ নেন লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের এসইভিপি এবং হেড অব অপারেশন একেএম কামরুজ্জামান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম।

আইসিএমএবি প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন আকন্দ তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য সর্বস্তরের সবারই নিজেদের জায়গা থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। পেশাদার হিসাব বিজ্ঞানীদের সংগঠন হিসেবে বাজেট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের প্রতি নীতিগত প্রস্তাবনা এবং পরামর্শ প্রদান আইসিএমএবির একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাজস্ব আহরণ ও বৃদ্ধি এবং সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের বিষয়ে স্বচ্ছতা সৃষ্টিতে সিএমএ পেশাদাররা বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ রাখেন।

আইসিএমএবি ভাইস প্রেসিডেন্ট মামুনুর রশীদ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জাতীয় বাজেট ২০২০-২১-এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবনা-সম্পৃক্ত একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনায় ১৩টি মূল প্রস্তাবনা সমৃদ্ধ এ পত্রে কোম্পানি রিটার্নের সঙ্গে ‘কস্ট স্টেটমেন্ট অ্যাকোম্পানিড বাই কোয়ান্টিটেটিভ অ্যানালিসিস স্টেটমেন্টস কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএমএ) কর্তৃক নিরীক্ষাকৃত সনদ’ সংযোজনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

চলমান পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের পরিমাণ দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে সর্বনি¤œ চার লাখ করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

মামুনুর রশীদ এফসিএমএ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে একে শক্তিশালী করে তোলার প্রতি জোর দেন, স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে নতুন করে সাজাতে হবে, যাতে করে চলমান সংকট এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির যথাসম্ভব মোকাবিলা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান সরকারের প্রতিটি খাতে ব্যয়ের মান নিরুপণে নিরীক্ষণ বা অডিট প্রক্রিয়াকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আলোকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতকে যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, এ বছরের বাজেটকে আমি বলব হেলথ বাজেট, এটি আমাদের বেঁচে থাকার বাজেট। আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়েও যথাযথ গুরুত্ব প্রদান এবং এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে পালনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির পরামর্শ দেন তিনি। চলতি বছরের বাজেটকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং এ চলমান সংকটকে মোকাবিলা করে টিকে থাকার বাজেট হিসেবে উল্লেখ করতে চান তিনি। এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ক্ষতিও মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে অনেক দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম প্রণয়ন করা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন খাতে আমাদের কিছু ব্যয় হয় যেগুলো একেবারেই প্রয়োজনীয় নয়। এ ধরনের ব্যয়গুলো যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে। স্বাস্থ্য খাত এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনিও। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য যে সব খাতগুলো বন্ধ থেকেছে, এগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে যাতে করে এগুলো টিকে থাকতে পারে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছরের বাজেট অন্যান্য যে কোনো সময়ের বাজেটের চেয়ে ভিন্ন। এবারের বাজেটের নিরুপণ হওয়া উচিত স্বাস্থ্য, মানবিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে। এ বিষয়গুলো এই সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রঞ্জন কুমার ভৌমিক মার্জিনাল ট্যাক্স পেমেন্টের ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ সীমা আড়াই লাখ থেকে বৃদ্ধির বিষয়ে একটি ভিন্ন প্রস্তাবনাও বিবেচনার কথা বলেন। তিনি বলেন, আড়াই লাখ টাকার উপরে আয় গেলে সেখান থেকে ১০ শতাংশ করের বিধান রয়েছে। এ কারণে আমরা এটিকে বাড়াতে বলি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেটা করা হয়, এ হারটিকে পাঁচ শতাংশ করা হয়। কাজেই আমরা এ ব্যাপারটিও মার্জিনাল ট্যাক্সদাতাদের ক্ষেত্রে ভেবে দেখতে পারি।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী বলেন, কর প্রদান বিষয়ে আমাদের যথাযথ জ্ঞান সৃষ্টি হওয়া খুবই জরুরি। অনেকেই এ বিষয়ে যথাযথ সচেতন থাকেন না। আমাদের মধ্যে যারা উপযোগী তাদের অবশ্যই কর প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি নিজস্ব দায়িত্ব পালন করা উচিত। আর এ জন্য ট্যাক্স অথরিটিকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে করে রাজস্ব বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম সঞ্চালনার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত বেকারত্ব সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে এ পরিস্থিতির কারণে ২৭ কোটি লোক চাকরিহীন হয়ে পড়বে বলে আইএলও’র পরিসংখ্যানে এসেছে। বাংলাদেশেও এ সংকট আসবে। এ প্রেক্ষিতে সরকার বেশ কয়েকটি খাতে এরই মধ্যে সহায়তা প্রদান করেছে। বাজেটের ক্ষেত্রেও এ বিষয়গুলোর প্রতিফলন আশা করেন তিনি।

বক্তব্যে আইসিএমএবি কাউন্সিল সদস্য একেএম কামরুজ্জামান বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আলিবাবা’র কর্নধার জ্যাক মা’র বক্তব্য এবং ড. আতিউর রহমানের বক্তব্যের আলোকে বলেন, ‘এ বছরের বাজেট আমাদের টিকে থাকার বাজেট। চলমান পরিস্থিতিতে আমরা যদি কোনোমতে টিকে যেতে পারি, সেটাই হবে আমাদের লাভ। আর তা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আগামী বছর আমাদের জন্য সাফল্যময় এক সোনালি বছর হবে।’