নিজস্ব প্রতিবেদক: পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সংগতি রেখে করহার কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একইসঙ্গে করদাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে ট্যাক্স কার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। গতকাল এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ট্যাক্স কার্ড ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির (ভার্চুয়াল) তিনি এ পরামর্শ দেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ করদাতা পাঁচ কোম্পানি এবং পাঁচ ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতাকে ট্যাক্সকার্ড ও সম্মাননা তুলে দেয়া হয়। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে কভিডে মারা যাওয়া আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারকে সম্মাননা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে (ভার্চুয়ালি) সব কমিশনার সংযুক্ত ছিলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোন করহারটা ধার্য করলে রাজস্ব বাড়বে এবং যারা ট্যাক্স দিচ্ছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সেটা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। রেট যদি বেশি থাকে ট্যাক্সপেয়াররা গ্রহণ করতে চাইবে না। আপনারা আশেপাশের দেশগুলোতে দেখেন, তারা কত হারে ট্যাক্স আদায় করে। সেটা দেখে রেট নির্ধারণ করতে পারেন। আমি ওদের চেয়ে বেশি নিতে চাই না, কমও নিতে চাই না। যদি রেট বেশি থাকে, তাহলে ট্যাক্স রেট কমাতে হবে। রেট কমানো হলে ট্যাক্স বাড়বে।
তিনি বলেন, জিডিপি অনুপাতে আমাদের রেভিনিউ জেনারেট কম। এ রেট বাড়াতে আমাদের ম্যানুয়াল সিস্টেম পরিহার করে ডিজিটাল সিস্টেমে যেতে হবে। ট্যাক্স আদায় করতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের সার্ভারের সঙ্গে রেস্টুরেন্টগুলো সম্পৃক্ত করুন। অটোমেশন পদ্ধতি চালু করুন। ট্যাক্স আদায়ে অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেখানে আমরা কথা দিয়েছিলাম অটোমেশন করব, এটা কিছুই হয়নি। দিস ইজ টু মাচ। আপনারা দয়া করে এখানে হাত দেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, জনগণ ট্যাক্স দিতে চায়, আমরা সেগুলো নিতে পারছি না। ট্যাক্স আদায়ের পদ্ধতিতে অটোমেশন করে সহজ করতে হবে। তাহলে যারা ট্যাক্স দেয়ার জন্য উপযুক্ত, সেটা আদায় করতে পারব। এনবিআর চেয়ারম্যান ছোট পরিসরে এ বিষয় মিটিং করে এটা আদায় করতে পারবেন। দেখতেও খারাপ দেখায়, ১০ বছর আগেও আমাদের ট্যাক্স জিডিপির ১০ শতাংশ ছিল, এখনও সেখানে আছি।
জনগণের মধ্যে ট্যাক্স দেয়ার ভয়ভীতি দূর হয়েছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন আমাদের রেভিনিউ কালেকশন পদ্ধতি উন্নত করতে হবে। এ রেভিনিউ জেনারেটকে আমরা ব্যবসাবান্ধব করতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একদিকে রেভিনিউ জেনারেট করব, আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করব। চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, করদাতাদের উৎসাহ দিতে ট্যাক্স কার্ডের সংখ্যা ৫০০, ১০০০, ২০০০, ৪০০০, ১০ হাজার করেন। এতে করদাতারা আরও বেশি কর দিতে উৎসাহ পাবেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, পরিপূর্ণ ই-ট্যাক্স ব্যবস্থা চালুর অংশ হিসেবে ই-টিআইএন ও ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত এক দশকে আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশের বেশি। আর করদাতা বৃদ্ধির হার ৩৫৭ শতাংশ। কর জিডিপির অনুপাত বেড়েছে ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। জনসংখ্যার তুলনায় করদাতার সংখ্যা বেড়েছে ৩১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজ করতে হবে।
কর আদায় বৃদ্ধিতে কয়েকটি প্রস্তাব করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অহেতুক ভয়ের কারণে অনেকে কর দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। করভীতি দূর করতে উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষম করে তুলতে হবে। কর প্রদান পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে। সব পর্যায়ে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাপনির্ভর রিটার্ন দাখিল চালু করা প্রয়োজন। ই-পেমেন্ট পদ্ধতির বহু প্রচলন চালু, রিয়েল টাইম ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করতে হবে। অনলাইন ও ডিজিটাল ইকোনমি হতে কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, করদাতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে ডেটা ভেরিফিকেশনে কাজ করছি। সেকেন্ডারি সোর্স থেকে তথ্য নেয়ার জন্য বিআরটিএ, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদান করছি। আরও কিছু এজেন্সির সঙ্গে সেকেন্ডারি তথ্য নিয়ে কাজ করছি। করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা ও করভীতি দূর করা আমাদের উদ্দেশ্য। এর বড় সমাধান হতে পারে অটোমেশন।
জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ কর প্রদানকারী পাঁচ কোম্পানি ও পাঁচজন ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে গ্রামীণফোন, সেখ আকিজ উদ্দিন লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লি.। ব্যক্তি শ্রেণির পাঁচজন করদাতা হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, রুবাইয়াত ফারজানা হোসেন, হোসনেয়ারা হোসেন, লায়লা হোসেন ও কাউছ মিয়া।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণকারী কর বিভাগের আট কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন সুধাংশু কুমার সাহা, এসএম আবুল খায়ের, সাব্বির আহমেদ, শরীফ মো. নুরুল ইসলাম, মঞ্জুর হোসেন খন্দকার, খন্দকার মকসুদুর রহমান, মজিদুল ইসলাম তালুকদার ও অশোক কুমার দাস। তাদের পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।
অন্যদিকে, ঢাকাসহ সারাদেশে কর অঞ্চলসমূহে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ করদাতাদের ট্যাক্স কার্ড ও সম্মাননা দেয়া হয়েছে। এ বছর ৩৬টি ক্যাটেগরিতে ১৪১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এবং দীর্ঘ মেয়াদে কর প্রদানকারী ৫২৪ করদাতাকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে।