Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 2:21 pm

করোনায় আক্রান্তের চেয়ে বেকারত্ব নিয়েই চিন্তিত বেশিরভাগ মানুষ

মাসুম বিল্লাহ: করোনা আতঙ্কে সবাই এখন ঘরে আবদ্ধ। সংক্রমনের ভয়ে কেউই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। চার সপ্তাহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে, তা কারও জানা নেই। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের এই দুঃসময়ে বেশিরভাগ মানুষ জীবন-মরণ নিয়ে চিন্তা করলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করছেন জীবিকা নিয়ে।

বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীরা বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিষয়টি এক প্রকার মানসিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। নিদ্রাহীনতা, ওজন কমে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্য হারানোর মতো সমস্যায় রয়েছেন ঘরে আবদ্ধ মানুষগুলো। শেয়ার বিজের অনলাইনভিত্তিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে উঠে এসেছে শতকরা আশি ভাগ বেসরকারি কর্মজীবী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে জীবিকা নিয়ে বেশি চিন্তিত। নিম্নবিত্তরা আগামী দিনগুলোতে কি করবেন, কি খাবেন এ নিয়েই বেশি চিন্তিত। করোনায় আক্রান্ত হলে তারা বেঁচে যাবেন না মারা যাবেন- এ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

নিম্ন-মধ্যবিত্তরা মনে করেন, করোনায় আক্রান্ত হলেও তারা বেঁচে যাবেন, কিন্তু এভাবে আর দু’মাস চললে তারা কর্মহীন হয়ে পড়বেন। থেমে যাবে জীবনের গতি। মধ্যবিত্তরা মনে করছেন, করোনায় আক্রান্ত হলে ভালো চিকিৎসা পাবেন না। ৬০ শতাংশ মধ্যবিত্ত এ ধারণা পোষণ করছেন। ফলে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না তারা। সরকারি চাকরিজীবীরা চাকরি হারানোর ভয় না করলেও তারা চিন্তিত পরিবার নিয়ে। করোনায় আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসা পাবেন কিনা, তা নিয়ে ৮০ শতাংশই মানুষই সন্দিহান। সবমিলে করোনা সবাইকেই এক ধরনের মানসিক অশান্তিতে ফেলে দিয়েছে।

ঢাকার বড় এক উদ্যোক্তা এম হোসেন। তার পরিবারের তিন প্রজন্ম ব্যবসায় যুক্ত। বয়স ৬০। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও যাননি তিনি। মহামারিতে এলাকা ছাড়তে নেই- ইসলামের এ বিধান মেনে বাসায়ই আছেন। কোথাও বের হচ্ছেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। করোনা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসা পাবেন কিনা তা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েও তিনি চিন্তিত। সবকিছু বন্ধ থাকলে তার ব্যবসার কি হবে, হাজারো কর্মীও দায়িত্ব তিনি কিভাবে নেবেন- এমন নানা দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে।

বিদেশি একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন সাইদা আক্তার। তিনি বলেন, করোনা তাকে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অফিসে যেতে হয় না। কিন্তু বাসায়ই অফিসের কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো অফিস আওয়ার নেই, নেই কোনো উইকএন্ড। বাসায় কাজের লোক নেই। সবকিছু তাকেই সামলাতে হচ্ছে। তারপরে করোনা আতঙ্কে সারাক্ষণ এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে।

আইটি খাতে কাজ করেন সোহাগ। তিনি বলেন, তার প্রচন্ড ঘুমে সমস্যা হচ্ছে। ভোর চারটা-পাঁচটা বেজে যায়, তার পর তারও ঘুম আসে না। বিছানায় গেলেই পরিবার, নিজের চিন্তার পাশাপাশি কর্মস্থলের চিন্তা তাকে পেয়ে বসে। শত চেষ্টায়ও তার ঘুম আসে না।

গণমাধ্যম কর্মী আর রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, করোনা নিয়ে তিনি ভাবতে চান না। এ জন্য সারা দিন অনলাইনে ব্যস্ত থাকেন। তারপরেও রাতে চোখ বন্ধ করলেই নানা দুশ্চিন্তা ভর করে। এই অবস্থার মধ্যে চাকরি হারালে কী করবেন। বাসা ভাড়া, সংসার খরচ, পরিবার নিয়ে কি করবেন। এছাড়া ছেলে মেয়েদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে কি করবেন?

বেসরকারি খাতে কাজ করেন এমন একজন বলেন, আগে সারা দিন পরিশ্রম করতাম। এখন তার কোনো উপায় নেই। এ জন্য প্রতিদিন রোজা থাকেন। রোজা থাকলে শরীর ক্লান্ত হবে এবং ভালো ঘুম হবে। কিন্তু করেনা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। মাকে নিয়ে যতো চিন্তা তার। আর এ চিন্তাই তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে গত চার সপ্তাহ।

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করেন ফয়সল। অনেক সুখের সংসার তার। কিন্তু করোনা তার সুখ কেড়ে নিয়েছে। চাকরি আর পরিবারের লোকদের নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি। তিনি মনে করেন, এভাবে বন্ধ থাকলে বেসরকারি খাত শেষ হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে কর্মীরা বেকার হয়ে পড়বেন। তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বেকারদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সুযোগ নেই। তাই এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। উন্নত বিশ্বের বেকার ভাতার সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশে এ সুযোগ নেই।

বিদেশি চেইন রেস্টুরেন্টের অপারেশন ম্যানেজার ইশতিয়াক ইকবাল বলেন, করেনার কারণে গত কয়েক মাস আমাদের চারটি ব্র্যান্ডের ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিল। এখন তো সব বন্ধ। আমি সবসময় ইতিবাচকভাবেই ভাবছি। দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আবারও রেস্তোরাঁ গুলো অতিথিদের পদচারণায় মুখর হবে। সচল হয়ে উঠবে অর্থনীতির গতি।

গুলশানের একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করেন চান মিয়া। বেতন পান নয় হাজার টাকা। করেনা নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। তবে বেকার হলে সে কোথায় থাকবে, কি খাবে- এ নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। চান মিয়া বলেন, চাকরিটা চলে গেলে মাকে নিয়ে তাকে পথে বসতে হবে। এই দুর্যোগে নতুন একটি চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে না।

গণমাধ্যমকর্মী রতন কুমার বলেন, আমাদের সরকার প্রায় সব খাতে প্রণোদনা দিতে চাচ্ছে, কিন্তু বাদ রেখেছে গণমাধ্যমকে। বিপজ্জনক অবস্থা। এটা মানসিক দুশ্চিন্তার বড় কারণ। অথচ গণমাধ্যমও এ করোনাকালে ফ্রন্ট ফাইটারের ভূমিকায় রয়েছে।
এসব কারণে ঠিকমতো ঘুম হয় না আমার। ঘুমানোর আশায় রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বিছানায় যাই। অথচ ঘুম আসে ভোররাতে। উঠতে উঠতে সকাল ৯টা-১০টা বাজে। মনে হয় না যে, রাতে ঘুমিয়েছি। দুর্বল লাগে, মন খারাপ থাকে। ভয়াবহ অবস্থা।

এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী সাখাওয়াত শরিফ লিটন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কম বেশি সবাই মানসিক সমস্যায় আছেন। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত সম্পদশালীরা। কারণ লকডাউনে তাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার হবে না। ফলে সম্পদের মূল্য কমবে। বাড়বে দায়। তবে নিম্নবিত্তরা দ্রুতই মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠবে।

কারণ তাদের খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বেশি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। তাদেরকে সময় দিতে হবে। ব্যস্ত রাখতে হবে। না হলে তারা মানসিক সমস্যায় ভুগবে। এ অবস্থায় সবার ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।